তিনি কখনোই ‘ওহ ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন’ জাতীয় ভালোবাসাটা পাননি। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বড় সাফল্যটা এনে দিলেও তাঁকে নিয়ে হই হুল্লোড় হয়নি। তাঁর ব্যক্তিত্বের চর্চাও সেভাবে কখনো হয়নি। হয়তো পরিসংখ্যান, চারপাশের অবস্থা কোন কিছুই তাঁর পক্ষে কথা বলছেনা। তবুও একটা দু:সাহস নিয়ে বলতে হয় টেস্ট ক্রিকেটে তিনি বাংলাদেশকে একটা পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন যেটা আর কেউ পারেনি। আর সে কারণেই একটা করুণ সুর কানে বাজছে- ‘একটা ধন্যবাদ কী আমি পেতে পারতাম না?’
বাংলাদেশের সদ্য বিদায়ী টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হকের কথাই বলছিলাম। গত সপ্তাহখানেক টেস্ট অধিনায়ক নিয়ে দেশের ক্রিকেটপাড়া কম গরম হয়নি। মুমিনুল রান পাচ্ছিলেন না, অধিনায়কত্বের চাপ নিতে পারছিলেন না তাই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়েছেন এটুকু খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে এর বাইরেও আরো যা যা হয়েছে সেটাই প্রমাণ করে আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতির কী দুরাবস্থা। সেই দায় যতটুকু বোর্ডের, ততটুকু সমর্থকদের, ততটুকু সাংবাদিকদেরও।
গত কয়েকদিনে মুমিনুল হককে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ট্রল হয়েছে সেটা তাঁর প্রাপ্য ছিল না। তর্ক সাপেক্ষে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান। স্রেফ একটা ব্যাড প্যাচের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। দুনিয়ার সব ব্যাটসম্যানই এই সময়টা পার করে। এই সময়টাতে প্রয়োজন ছিল সবার মুমিনুলের পাশে থাকা।
তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে হারের পরই জোর গুঞ্জন উঠে সাদা পোশাকের ক্রিকেটের জন্য নতুন অধিনায়ক খুঁজছে বাংলাদেশ। সেই গুঞ্জনের সত্যতা পাওয়া যায় বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বাসায় মুমিনুলের সাথে বৈঠকের পর। বৈঠক শেষে মুমিনুল জানিয়েছিলেন তিনি আর অধিনায়কত্বটা করতে চাইছেন না। তিনি আসলেই চাইছিলেন না নাকি তাঁকে জোর করা হয়েছে সেই আলোচনায় যেতে চাই না।
তবে অধিনায়ক মুমিনুলকে একবার খুব সম্ভবত শেষবার পরখ করে দেখতে চাই। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ তখন একটা হাহাকারের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। সেই সময়ের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসান নিষিদ্ধ হলে কোন অধিনায়কই খুঁজে পাচ্ছিল না বাংলাদেশ। আর তখনই ছিল ভারতের মাটিতে পূর্নাঙ্গ সফর। ফলে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকেই মুমিনুলকে অধিনায়ক ঘোষণা করে হাফ ছেড়ে বাঁচে বোর্ড।
আর ওই কঠিন সময়টাতে অধিনায়কত্বের দায়িত্বটা নিতে পিছুপা হননি তিনি। সেই থেকে এবছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঢাকা টেস্ট পর্যন্ত তিনি ছিলেন সাদা পোশাকের ক্রিকেটে বাংলাদেশের অধিনায়ক। পরিসংখ্যানের খাতা হাতড়ালে আপনাকে হতাশই হতে হবে। এই সময়ে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে মাত্র তিনটা। দুইটাই আবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তবে একটি জয় মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
পরিসংখ্যান তাঁর হয়ে কথা বলছেনা। আবার তাঁর ব্যক্তিত্বও ঠিক অধিনায়ক সুলভ ছিল না। তাঁর মধ্যে সেই নেতা ব্যাপারটা বাইরে থেকে অনুভূত হতো না। দলে অধিনায়ক হিসেবে তাঁর প্রভাব কতখানি এমন প্রশ্নও ছিল। এছাড়া রিভিউ নেয়া, না নেয়াও ছিল সমালোচনার একটা বড় জায়গা। ফলে টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বড় সাফল্যটা এনে দিয়েও তিনি ভালবাসার অধিনায়ক হতে পারেননি।
কিন্তু মুমিনুল হক আস্তে আস্তে একটা টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, খানিকটা পেরেছিলেনও। টেস্ট ম্যাচ জিততে হলে পেসারদের সামনে এগিয়ে আসতে হবে এটা তিনি জানতেন। তবে ম্যাচ জেতানোর মত পেসার বাংলাদেশের ছিল না। তিনি যখন দায়িত্ব নেন তখন বাংলাদেশ না পারতে একজন পেসার নিয়ে মাঠে নামতো।
ফলে তিনি একটা পেস ব্যাটারি তৈরি করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। টানা ব্যর্থতার পরেও এবাদত, খালেদদের খেলিয়ে গিয়েছেন। তাসকিন, শরিফুলদের উপর ভরসা রেখেছেন। ফলে গত এক বছরে এই পেসাররা বাংলাদেশকে প্রতিদান দিতে শুরু করেছেন। তাসকিন, এবাদতরা বিদেশের মাটিতে ম্যাচ জেতানোর জন্য তৈরি হয়েছেন।
এছাড়া তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের একটা এলোমেলো অবস্থা ছিল। ঠিক একাদশ সাজানোটাই কঠিন ছিল। সাকিব নিষিদ্ধ হয়েছেন, তামিম, রিয়াদ নিয়মিত না, ভরসা করার মত কোন পেসার নেই। সেই অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে তিনি দলটাকে গুছিয়ে নিয়েছেন।
সাকিবের হাতে একটা গোছানো দলই তুলে দিলেন। একমাত্র তিন নাম্বারে খেলা নাজমুল হাসান শান্তকে নিয়ে একটু প্রশ্ন আছে। তবে ব্যাকআপ হিসেবে ইয়াসির আলি রাব্বিও প্রস্তুত আছেন। দারুণ একটা পেস আক্রমণ গড়ে উঠেছে।
সবমিলিয়ে একটা কঠিন সময় থেকে তিনি দলটাকে সাজিয়েছেন। একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন। পেস আক্রমণ তৈরি করেছেন। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ ভালো খেলতে শুরু করেছে। এসবকিছুর জন্য মুমিনুল তো অন্তত একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। বিদায় বেলায় একটূ সম্মান তো তিনি পেতেই পারেন।