সব ক্রীড়াবিদেরই পছন্দের দু-একটা মাঠ কিংবা প্রতিযোগিতা থাকে। ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন ভালোবাসতেন কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সকে। এখানে খেলতে নামলে অফ-ফর্মে থাকলেও আজহারের ব্যাট থেকে আসতো ঈর্ষনীয় সব ইনিংস। সিডনির মাঠকে এতটাই ভালবাসতেন ব্রায়ান লারা যে নিজের মেয়ের নামই রেখে দিয়েছেন সিডনি। আবার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তো উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেলায় নামলে যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেন।
ঠিক এদের মতই টেনিসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় রাফায়েল নাদালেরও নিজস্ব সাম্রাজ্য রয়েছে। ফরাসি ওপেন মানেই রাফায়েল নাদালের রাজত্ব। ক্লে কোর্টে নামলেই দুর্ভেদ্য আর অজেয় হয়ে ওঠেন স্প্যানিশ এই টেনিস তারকা। সেই ২০০৫ সালে যে রাজত্ব শুরু করেছেন, তা এখনও ধরে রেখেছেন নাদাল।
আর এবার ২০২২ সালে ফ্রেঞ্চ ওপেন খেলতে নেমে আরো একবার প্রমাণ করলেন কেন তাকে ক্লে কোর্টের রাজা বলা হয়। এবারের আসরে শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে নওয়ের ক্যাসপার রুডকে পাত্তাই দিলেন না নাদাল, দাপুটে পারফরম্যান্সে জিতে নিলেন রোলাঁ গাঁরোর শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট।
রোববার ফরাসি ওপেনের ফাইনালে রুডকে সরাসরি সেটে হারিয়ে বিজয়ের হাসি হাসেন নাদাল। প্যারিসে অনুষ্ঠিত একপেশে ম্যাচে রুডকে ৬-৩, ৬-৩, ৬-০ গেমে হারিয়েছেন নাদাল। ফরাসী ওপেনে এটি তার রেকর্ড ১৪তম শিরোপা। ক্লে কোর্টের আরেক কিংবদন্তি বিয়ন বোর্গ ফরাসী ওপেনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬টি শিরোপা জিতেছেন। নোভাক জোকোভিচ দুটি ও রজার ফেদেরার জিতেছেন একটি শিরোপা।
অন্যদিকে এটি নাদালের রেকর্ড ২২তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা। চলতি বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে রজার ফেদেরার ও নোভাক জোকোভিচকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়েন স্প্যানিশ এই টেনিস কিংবদন্তি। ফেদেরার ও জোকোভিচ দুইজনই সমান ২০টি করে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন।
রাফায়েল নাদালের চাচা সাবেক টেনিস তারকা হওয়ার সুবাদে টেনিসের খুঁটিনাটি শিখতে প্রশিক্ষক ভাড়া করতে হয়নি তাকে। চাচার সহায়তায় মাত্র ১৫ বছর বয়সেই প্রতিযোগিতামূলক টেনিসে পা রাখতে সক্ষম হন তিনি। আর সেই থেকে বর্তমানে ৩৫ বছর বয়সেও তিনি অব্যাহতভাবে শীর্ষ পর্যায়ে নিজের আধিপত্য ধরে রেখেছেন।
‘দ্য স্প্যানিশ বুল’-খ্যাত এই তারকা ২০ বছরের পেশাদার টেনিস ক্যারিয়ারে এখন অবধি জিতেছেন ৮৩টি শিরোপা। সর্বোচ্চ গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা জেতার পাশাপাশি স্পেনের হয়ে বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণপদকও জিতেছেন তিনি। নিজের ক্যারিয়ারকে যেমনভাবে তুলেছেন শীর্ষ পর্যায়ে, তেমনই নিজের দেশের পতাকাকেও তুলে ধরেছেন সারা বিশ্বের মাঝে। যার কারণে স্পেনের ছেলে-বুড়ো সবার নিকট দেশটির ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন এই টেনিস তারকা।
তবে সব প্রতিযোগিতার মাঝেও নাদালের জন্য বিশেষ ফ্রেঞ্চ ওপেন। ২০০৫ থেকে ফরাসী ওপেনে শাসন শুরু হয় তার, ২০০৮ সাল পর্যন্ত জেতেন টানা চারটি শিরোপা। ২০০৯ সালে ফেদেরারের কাছে শ্রেষ্ঠত্ব হারাতে হয় তাকে। কিন্তু ২০১০ থেকে আবারও নাদালের শিরোপার গল্প। ২০১৪ পর্যন্ত টানা পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হন তিনি।
পরের দুই বছর ফাইনালে উঠতে পারেননি নাদাল। ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত আরও চারবার সেরার মুকুট জেতেন এই স্প্যানিয়ার্ড। ২০২১ সালে শিরোপা জেতেন জোকোভিচ, পরের বছরই পুনরায় লাল দুর্গের রাজত্ব নিজের করে নিলেন ৩৬ বছর বয়সী নাদাল।
কাদামাটির কোর্টে রাফায়েল নাদালের এমন আধিপত্য অবশ্য কাকতালীয় নয়। নাদালের খেলার ধরনের সাথে বেশ ভাবেই মিলে যায় এই কোর্টের বৈশিষ্ট্যগুলো। যেমন কাদামাটির তৈরি হওয়ায় টেনিস বল এখানে ধীর গতি হয়ে যায় কিন্তু বাউন্স এবং সুইং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। আর নাদালের শক্তির জায়গাই সুইং। এছাড়া তার প্রিয় ফোরহ্যান্ড শট খেলার জন্য মাটির তৈরি ক্লে কোর্ট সবচেয়ে আদর্শ স্থান। তাছাড়া লম্বা সময় ধরে খেলতে পারার দক্ষতাও এক্ষেত্রে এগিয়ে রাখে স্প্যানিশ তারকাকে।
নিজের ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য একটা সময় হাঁটুর ইনজুরিতে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে নাদালকে। আর এই ইনজুরি নিয়েও শীর্ষ পর্যায়ে লড়াই করে গিয়েছেন নাদাল। নিজের রাজত্ব ক্লে কোর্টকে সন্তানের মতোই আগলে রেখেছেন। সেই সাথে টেনিসের এই সুপারস্টার ভক্তদের উপহার দিয়েছেন কয়েক ডজন রোমাঞ্চকর ম্যাচ।
তার শরীর একজন সত্যিকারের যোদ্ধার মতো, আর তার মাঝে উপস্থিত ‘হার না মানা মানসিকতা’ যেন একজন প্রকৃত যোদ্ধার প্রতিরূপ। এই যেমন সেমিফাইনালের লড়াই-তে বারবার পিছিয়ে পড়েও হাল ছাড়েননি রাফায়েল। অবশ্য শেষটা মন:পূত হওয়ার কথা নয়। প্রথম সেটে নাদাল জিতলেও দ্বিতীয় সেট শেষ হওয়ার আগেই গোড়ালির ইনজুরিতে ছিটকে গিয়েছেন নাদালের প্রতিপক্ষ আলেক্সান্ডার সাচা৷
জন্ম আর বেড়ে ওঠাটা বার্সেলোনা কিংবা মায়োর্কার মতো জায়গায় বলে কাদামাটির কোর্টে নাদালের ভালো খেলাটা বোধহয় বিধাতার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ভালো খেলা নয়, অজেয় হবার তীব্র ইচ্ছেই নাদালকে এনে দিয়েছে কিংবদন্তি’র মর্যাদা। পৃথিবীতে যতদিন ক্লে কোর্ট, র্যাকেট আর টেনিসের এই বল থাকবে ততদিন ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করবে একজন রাফায়েল নাদালের নাম।