তেজনারাইন চন্দরপল অবশেষে জাতীয় দলের সীমানায়। মূল স্কোয়াডে না হলেও বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের দলে তিনি আছেন রিজার্ভ তালিকায়। তাঁর নাম কিংবা এই ছবি দেখেই তাঁর পরিচয় নিশ্চয়ই পরিস্কার। শিবনারাইনের ছেলে তেজনারাইন ব্র্যান্ডন চন্দরপল।
এইটুকু আসতেও আসলে অনেকটা সময় লেগে গেল তার। গায়ানায় বা ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে তাকে নিয়ে অনেক বড় আশা ছিল। তেজনারাইনের কথা প্রথম পড়েছিলাম সম্ভবত ১২-১৩ বছর আগে। তখন ফিচার পাতায় খেলোয়াড়দের প্রোফাইল লিখতাম। শিবের প্রোফাইল লিখতে জেনেছিলাম তার বাবা আর ছেলের কথা। শুরুতে অবশ্য মনে করেছিলাম, ছেলের নাম ত্যাগনারাইন। পরে জেনেছি, উচ্চারণটা হবে তেজেনারাইন (pronounced Tay-je-narine), দ্রুত করে ‘তেজনারাইন’ বলে।
যাহোক, শিবের বাবা খেমরাজ। গায়ানার ইউনিটি গ্রামের খ্যাপাটে চরিত্র। পেশা তার মাছ ধরা। তবে প্রচণ্ড ক্রিকেট পাগল। ছেলেকে টেস্ট ক্রিকেটার বানাবেন, এটাকে বলা যায় ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। ছোট্ট শিবকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটিং অনুশীলন করাতেন। আটলান্টিকের পাড়ে নিয়ে শরীর তাক করে বাউন্সার মারতেন। প্রচুর বলের আঘাত গায়ে সয়ে তবে গড়ে উঠেছিলেন শিব।
ছেলের পর নাতিকেও নিজ হাতে গড়েছেন খেমরাজ। স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন দাদার সঙ্গে ক্রিকেট সেশন চলত তেজনারাইনের (বাড়িতে সবাই ডাকে ব্র্যান্ডন), ঠিক বাবা শিবের মতো করেই।
একটা পর্যায়ে শিবের বাবা-দাদা, সবই ছিলেন বলা যায় খেমরাজ। দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যামির সঙ্গে ফ্লোরিডায় থিতু হন শিব। তেজনারাইন রয়ে যান ইউনিটি গ্রামেই। তার মা অ্যানালি সেখানে বিয়ার গার্ডেন চালাতেন। কয়েক দিন মায়ের সঙ্গে, কয়েক দিন দাদার সঙ্গে, এভাবে মিলিয়ে থাকতেন তেজনারাইন।
পরে অবশ্য তেজনারাইনের ১৩-১৪ বছর বয়সে আবার গায়ানায় ফিরে আসেন শিব। ছেলের ক্রিকেট নিয়ে তিনিও তখন সিরিয়াস হন, ছেলেকে আলাদা করে সময় দিতে থাকেন ক্রিকেটে।
এরপর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের নানা ধাপ পেরিয়ে এগিয়ে যান তেজনারাইন। শিবের জিন যেহেতু, উইকেট আঁকড়ে রাখায় তখন থেকেই জুড়ি ছিল না তেজনারাইনের। তাই মাত্র ১৬ বছর বয়সে অভিষেক হয়ে যায় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। চতুর্থ ম্যাচেই বাবাকে পেয়ে যান সতীর্থ হিসেবে – এক দলে বাবা-ছেলে!
সেই ম্যাচে তেজনারাইনের রান ছিল ৪২ ও ২৯, শিবের ৮ ও ১০৮। জুটি হয়নি দুজনের। ছেলে ওপেনার, বাবা মিডল অর্ডার। তবে ২০১২ সালেই একটি ক্লাব ম্যাচে ২৫৬ রানের জুটি গড়েন বাপ-বেটা মিলে।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের পর এই বছরই ১৬ বছর বয়সে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে যুব ওয়ানডেতে অভিষেক হয় বাংলাদেশের বিপক্ষে। পরের বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ৫৮.৬০ গড়ে করেন ২৯৩ রান। দলের সর্বোচ্চ, টুর্নামেন্টের পঞ্চম সর্বোচ্চ।
এরপর তাঁর ক্যারিয়ার প্রত্যাশিত গতি পায়নি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খুব ধারাবাহিক হতে পারেননি। তাই জাতীয় দলে ডাক আসেনি। এবার কদিন আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পরপর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরির পর রিজার্ভ তালিকায় ঠাঁই পেলেন। বয়স হয়ে গেছেন এখন ২৬।
এই বয়সে তার বাবা ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং অর্ডারের বড় ভরসা। ছেলে কেবল টেস্ট দলে ঢুকি ঢুকি করছেন। শিবনারাইন চন্দরপলের ছেলে শোনার পর প্রথমেই যে কথাটি আপনার মাথায় আসার কথা, সেটির উত্তর, ‘হ্যাঁ’, ছেলেও বাবার মতো গার্ড নিয়ে ব্যাট দিয়ে বেল উইকেটে পুঁতে মার্ক করে রাখেন। তবে স্টান্সে মিল ততটা নেই। ছেলের স্টান্সও বেশ ওপেন, তবে অনেকটাই প্রথাগত। ব্যাক লিফট অবশ্য বাবার মতো ছেলেরও ‘হাই’।
তবে ব্যাটিংয়ের ধরন আর দর্শনে দুজন হুবুহু এক। তেজনারাইনও উইকেট আঁকড়ে রাখতে পছন্দ করেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকতে পারেন। সম্প্রতি যে দুটি সেঞ্চুরি করে এবার টেস্টে দলের রিজার্ভ তালিকায় এলেন, ওই দুটি সেঞ্চুরিতেও আছে সেই ছাপ। বারবাডোজে বিপক্ষে ৬৪৪ মিনিট খেলে ৪৩৪ বলে ১৪০। জ্যামাইকার বিপক্ষে ৫৬৭ মিনিটে ৪২৫ বলে ১৮৪।
বাবা-ছেলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বেশি কিছু ম্যাচেই খেলেছেন একসঙ্গে। দু’জন প্রথমবার একই প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ফিফটি করেন ২০১৭ সালে। জ্যামাইকার বিপক্ষে সেদিন ১৩৫ বলে ৫৮ করেন তেজনারাইন, ১৭৫ বলে ৫৭ শিবনারাইন।
১৯৫৭ সালে সিকে নাইডু ও সিএন নাইডুর পর একই প্রথম শ্রেণির ম্যাচে বাবা-ছেলের ফিফটির প্রথম নজির গড়েন চন্দরপলরা। ২০১৮ সালে ঘরোয়া ৫০ ওভারের ম্যাচের টুর্নামেন্টের সেমি-ফাইনালে বাবার স্ট্রেট ড্রাইভে বোলারের বুটে লেগে নন-স্ট্রাইক প্রান্তে রান আউট হয়ে যান ছেলে।
৪৮ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে তেজনারাইনের রান এখন ৪ সেঞ্চুরিতে ২৫১১, গড় ৩২.৬১। ক্যারিবিয়ায় অবশ্য বেশির ভাগ উইকেটই খুব কঠিন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রান ও গড় কমই থাকে বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানের। তবে তেজনারাইন প্রত্যাশিত গতিতে উন্নতি করতে পারেননি, সেটিও সত্যি।
এখন ধারাবাহিকতা কিছুটা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে কাল থেকে শুরু হতে যাওয়া প্রস্তুতি ম্যাচের দলেও তাকে রাখা হয়েছে। এখানে ভালো করলে সামনে টেস্ট দলের দুয়ার খুলে যেতেও পারে!
যা হোক, তেজনারাইনের প্রতি ব্যক্তিগত একটু কৃতজ্ঞতাও আছে। ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন বাংলাদেশ সফরে আসে, খুব চেষ্টা করছিলাম শিবের একটা ইন্টারভিউ করতে। স্বল্পভাষী শিব রাজি হন না কোনোমতেই। সিরিজের শেষ দিকে একদিন ছেলের কথা জিজ্ঞেস করার পর শিব থমকে দাঁড়ালেন, মন নরম হলো হয়তো। দাঁড়িয়ে তখন কয়েক মিনিট কথা বলেছিলেন। ব্যস, আমার স্টোরি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল!
– ফেসবুক থেকে