ক্রিকেটের ইতিহাসে কোনো একটি বিশেষ শট যে দশ বছর ধরে একটি দল ও তার সমর্থকদের জন্যে দুর্লঙ্ঘ মনস্তাত্ত্বিক এভারেস্ট তৈরি করতে পারে, তার উদাহরণ এই একটিই। ১৮ এপ্রিল ১৯৮৬ সালে শারজায় শেষ বলে যা হয়েছিল, তার বিষদ বিবরণে আর যাচ্ছি না।
যারা সরাসরি প্রতক্ষ্যদর্শী, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন এবং সম্ভবত অত্যন্ত বিষদেই ঘটনাবলী তাঁদের মনে গেঁথে আছে। আমাদের প্রজন্মের মনে যেমন ২০০২ নাটওয়েস্ট ফাইনাল বা ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল। যারা সরাসরি প্রতক্ষ্যদর্শী নন, তাঁদের জন্যে ইউটিউব নামক সংরক্ষণাগার তো রয়েইছে।
পুরোনো ক্ষতে নতুন করে খোঁচানোর প্রয়োজন নেই। তবে যে কারণে এই ঘটনার উল্লেখ, এই কীর্তির মালিক, ভারতের মানুষের মন যিনি দশ বছরের জন্য পাকাপাকি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে রেখেছিলেন, সেই জাভেদ মিয়াঁদাদের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই।
হলফ করে বলতে পারি, যখন খেলতেন তখন ভারতীয় দর্শকের মনে চরম বিরক্তির (যা কখনও কখনও ঘৃণায় পরিণত হতো) উদ্রেক করতেন। তবুও তাঁরা হয়তো মনে মনে ভাবতেন, ‘একটা জাভেদ যদি আমাদের থাকতো।’ সেই কোন কালে আব্দুল হাফিজ কারদার জাভেদকে দাগিয়ে দিয়েছিলেন, ‘দশকের আবিষ্কার’ হিসেবে।
এরকম তো কত খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেই বলা হয়ে থাকে। নরমান ও’নিল কে তো পরবর্তী ব্র্যাডম্যান বলা হতো। কিন্তু তার প্রতি সুবিচার কটা লোকই বা করতে পারেন? জাভেদ পেরেছিলেন। সেই ১৯৭৬ এ অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি থেকে শুরু। আমরা বাঙালিরা সৌরভ গাঙ্গুলিকে নিয়ে গর্ব করি যে তাঁর টেস্ট গড় কখনও ৪০-এর নিচে নামেনি। তা জাভেদ মিয়াঁদাদের টেস্ট গড় কখনও ৫০ এর নিচেই নামেনি। বিশ্বক্রিকেটে এমন নজির রয়েছে শুধুমাত্র আর একজনের-ইংল্যান্ডের সাটক্লিফ।
সুন্দর ক্রিকেট আর জাভেদ মিয়াঁদাদ, এই দুইয়ের সম্পর্ক কোনোদিনই দারুন মধুর ছিল না। তবে জাভেদের যা ছিল, সেটা এক ফেসবুক বন্ধু, পরাগ দারুণ ব্যাখ্যা করেছেন –
রক্তজুড়ে দু:সাহসী যুদ্ধকোষ
বুকজুড়ে বেপরোয়া মস্তান
স্নায়ুজুড়ে ইস্পাতের ফ্যাক্টরি
জাভেদের একেকটা বিখ্যাত কীর্তি খতিয়ে দেখুন, দেখবেন এগুলোর পরিচয় পাচ্ছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৯৮৭-৮৮ র সিরিজ টা দেখুন। প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরি। প্যাটারসন, আম্ব্রোস, ওয়ালশ পিটিয়ে। পাকিস্তানের জয়। দ্বিতীয় টেস্টে জাভেদের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ টেস্ট ইনিংস।
মার্শাল, অ্যাম্ব্রোস, ওয়ালশ রুখে ম্যাচ বাঁচানো এবং সময় সময় জয়ের স্বপ্ন দেখানো সেঞ্চুরি। ইমরানের পাকিস্তান যে সেই সময় এক মাত্র দল হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে না হেরে ফেরে, তার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান তো জাভেদেরই।
সেই সময়ে ক্যারিবিয়ান সফরে রান করতে টেকনিক, ভাগ্য ইত্যাদির পরেও আরেকটি জিনিসের প্রয়োজন হতো। দু:সাহস। যে দুঃসাহস অমরনাথ দেখিয়েছিলেন ১৯৮৩ সালের সফরে। যে দু:সাহস জাভেদ দেখান ১৯৮৭/৮৮ র সফরে। প্রসঙ্গত, এই সিরিজের আগে নাকি ইমরান জাভেদকে নিভৃতে গিয়ে বলেন, ‘ওহে! ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে তোমার ভালো ব্যাট করার আশা দেখছি না।’
ডেনিস লিলিকে ব্যাট নিয়ে তেড়ে যাওয়া। ১৯৯২ বিশ্বকাপে কিরণ মোরের অনুকরণ। ইমরানের সাথে ঝামেলা। সবেই তো জাভেদের এই বেপরোয়া মস্তানির উদাহরণ। আসলে ওসমান সামিউদ্দিন তাঁর অসাধারণ বই ‘The Unquiet one’ এই বোধহয় ঠিক লিখেছেন। জাভেদের চালিকাশক্তি ছিল ‘ইজ্জত’।
প্রাক দেশভাগ আহমেদাবাদের পুলিশ কর্মী এবং ক্রিকেট পিপাসু বাবার সন্তান, জাভেদকে পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘হুজ হু’রা খানিক নিচু চোখেই দেখতেন। তাঁর ক্রিকেট জীবন কেটে গেছে, তাঁদের জবাব দিতে দিতে। তবে শচীন টেন্ডুলকারের মতো শুধু ব্যাটে নয়, মুখেও জবাব দিতেন জাভেদ।
পার্থে লিলির দিকে ব্যাট নিয়ে তেড়ে যাওয়ার আগে লিলি নাকি তাঁকে হালকা লাথি কষান। তবে তারও আগে থেকে নাকি জাভেদ লিলিকে এমন উত্যক্ত করেন যে লিলি আর সামলাতে পারেননি। তা জাভেদকে যখন পরে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ স্লেজিং তো চলছিলই। দু তরফেই। কিন্তু যখন লাথি মারলো, তখন তো তেড়ে যেতেই হতো। আমি তো আর মাদার তেরেসা নই।’
চুম্বকে এটাই জাভেদ।
অসাধারণ ট্যাকটিশিয়ান ছিলেন জাভেদ। কিন্তু ম্যান-ম্যানেজমেন্টে কিঞ্চিৎ কমা বলে ইমরানের মতো আলোচিত নন। তাতে কি? ইমরান নিজেও তো পরে স্বীকার করেছেন, তাঁর জমানায় বহু খুচখাচ ট্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্তের পিছনে জাভেদের হাত থাকতো। কোচ হবার পরেও শুধুমাত্র দলের সবাইকে সামলাতে না পারার কারণে জাভেদের চাকরি যায়। অধিনায়ক জাভেদ ইমরানের মতো ব্যক্তিত্বশালী নন। ভালো ম্যান-ম্যানেজার নন। কিন্তু ওস্তাদ ট্যাকটিশিয়ান হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
জাভেদের ব্যাটিং লাইভ দেখা হয়নি। পরে হাইলাইটে দেখে মনে হয়েছে, একদিকে ভালোই হয়েছে। কিন্তু আফসোস টা রয়ে গেছে জাভেদ যুগ টা ‘ম্যাহসুস’ করা হলো না বলে। করাচির মাঠে বসে আম্পায়ারিংয়ের কঠিনতম পরীক্ষাটা দেখা হলো না বলে। কি সেটা? পাকিস্তান ৫০ রানে ৪ উইকেট, জাভেদ ব্যাট করছেন, একটা বল তাঁর পায়ে লাগলো, প্লাম্ব এলবি। কিন্তু করাচিতে? জাভেদের বিরুদ্ধে? আপনি আম্পায়ার হলে কি করতেন ভাবুন।