ইট, স্লিপ, হিট ফিফটি, রিপিট

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক ও তারকা ব্যাটার হাবিবুল বাশার মিস্টার ফিফটি হিসেবে বেশ পরিচিত। পঞ্চাশোর্ধ অনেক ইনিংস খেললেও সেঞ্চুরিতে রূপান্তর করতে পেরেছেন এর গুটি কয়েক। তাই, মিস্টার ফিফটি তকমা জুড়ে দেওয়া হয় বাশারের নামের পাশে। তবে সেই তকমাটা তাঁর নামের পাশে কতদিন থাকবে সে নিয়ে আছে শঙ্কা! সেটি বাগিয়ে নিতে যেন তোরজোড়  চালাচ্ছেন পাকিস্তানি ওপেনার ইমাম উল হক।

গেল সাত ওয়ানডের সাতটিতেই খেলেছেন পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস। ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে ইমামের চেয়ে টানা সবচেয়ে বেশি পঞ্চাশোর্ধ ইনিংসের তালিকায় আছেন স্রেফ একজন – সাবেক পাকিস্তানি তারকা জাভেদ মিঁয়াদাদ। মিস্টার ফিফটির তকমা না নিলেও ‘মিস্টার কনসিস্টেন্ট’ তকমাটা গায়ে জড়াতে পারেন সহজে।

স্বজনপ্রীতির ছায়ায় থেকে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু। নিন্দুকদের নিন্দা কিংবা সমালোচকদের কট্টর সমালোচনা মাথায় নিয়ে ২২ গজ মাড়িয়েছেন। ক্রিকেটে ‘স্বজনপ্রীতি’ শব্দটা যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে; ব্যতিক্রম ছিলেন না ইমামও। চাচা ইনজামাম উল হক ছিলেন পাকিস্তানি ক্রিকেটের সাবেক অধিনায়ক ও তারকা ক্রিকেটার। ব্যাস, ইমামকে স্বজনপ্রীতির বেড়াজালে জাপটে ধরে নিন্দুকদের নিন্দার ঝড় শুরু।

রবীন্দ্রনাথ নিজের এক রচনায় বলেছিলেন, নিন্দা, দু:খ, বিরোধ যেন ভাল আর গুণী লোকের ভাগ্যেই জোটে বেশি। রবীন্দ্রনাথের কথাটা কোনো অংশেই ভুল কিংবা মিথ্যে নয়। পৃথিবীতে নিন্দা না থাকলে ভাল কাজের স্বীকৃতি কি পাওয়া যেত? নিন্দুকেরা বরাবরই অপেক্ষায় আছে আপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, আপনার ক্যারিয়ারে আঙুল তুলতে। নিন্দুকের মুখে সপাটে অদৃশ্য চড় বসাতে প্রয়োজন সফলতা। ইমাম সেটি করে দেখিয়েছেন। ব্যাট হাতে প্রতিটা সেঞ্চুরি বা ফিফটিতে নিন্দুকদের মুখে অদৃশ্য আঘাত করছেন।

ক্যারিয়ার শুরুর আগেই ছিল শেষ হবার উপক্রম। তবে, ব্যাট হাতে জবাবটা দিয়েছিলেন অভিষেক ম্যাচে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকে করেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি।

সেই যে শুরু, এখনও ইমাম ছুঁটছেন অবিরাম গতিতে। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা তিন ম্যাচেই খেলেন পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস। এর মধ্য দিয়ে গড়েছেন রেকর্ডও। ওয়ানডেতে টানা সাত ইনিংসে করেছেন পঞ্চাশোর্ধ স্কোর। এই রেকর্ডের চূঁড়ায় উঠতে পেছনে ফেলতে হবে স্বদেশী তারকা মিঁয়াদাদকে। মিয়াঁদাদের দখলে আছে ওয়ানডেতে টানা নয় হাফ সেঞ্চুরি করার বিশ্বরেকর্ড।

তিন ম্যাচে দুর্দান্ত পারফর্ম করে জিতেছেন সিরিজ সেরার পুরষ্কার। বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ান কিংবা শাহিন শাহ আফ্রিদিদের ভীড়ে ইমামের উপর লাইমলাইটটা খুব কম-ই থাকে। খানিকটা আড়ালে থেকে নিয়মিতই তিনি ব্যাট হাতে রানের ফোয়ারা ছুঁটিয়ে যাচ্ছেন। ওয়ানডে ইতিহাসে কমপক্ষে ২ হাজার রান করেছেন এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে গড়ের দিক থেকে বাবর আজম ও বিরাট কোহলির পরেই এখন ইমামের অবস্থান।

২০১৭ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর পরবর্তী দুই বছরে খেলেছেন ৩৭ ইনিংস। এই ৩৭ ইনিংসে প্রায় ৫৪ গড়ে করেছেন ১৭০০+ রান, স্ট্রাইক রেটে আশির খানিকটা বেশি। ২০২০ থেকে এখন অবধি খেলেছেন ১৪ ইনিংস। এই ১৪ ইনিংসে ৫৬ গড়ে করেছেন সাতশোর বেশি রান, স্ট্রাইক রেট এবার নব্বইয়েরও বেশি। রান পেলেও গেল দুই বছর ধরে স্ট্রাইক রেট নিয়েও চলছিল সমালোচনা।

‘স’ দিয়ে সব নেতিবাচক শব্দ যেন নিন্দুকরা জুড়ে দিচ্ছিলেন ইমামের নামের পাশে। প্রথমে স্বজনপ্রীতি, এরপর স্বার্থপর। দলের স্বার্থে না খেলে, ব্যক্তিগত অর্জনের দিকে মনযোগ তাঁর – এমনটাও শুনেছেন। ধীরগতির ইনিংস খেলে দলকে চাপে ঠেলে দিচ্ছেন? – জবাবটা এই ক্ষুদ্র পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট।

সেটিও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন ইমাম। অবশ্য চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস কিংবা মানসিকতা ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ছিল। নয়ত স্বজনপ্রীতির এই পাহাড়সম চাপ ঠেলে ২২ গজে টিকে থাকতে নিশ্চই পারতেন না। এবারও চ্যালেঞ্জটা সহজেই উতরে গেলেন তিনি। চলতি বছর ওয়ানডেতে প্রায় ৯৯ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ইমাম।

আইসিসি ওয়ানডে চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ওয়ানডে ব্যাটিং র‍্যাঙ্কিংয়ে বিরাট কোহলিকে টপকে শীগ্রই হয়ত উঠে আসবেন দুইয়ে।

চাচা ইনজামাম উল হক-ই তাঁর অনুপ্রেরণা। ইনজির হাত ধরেই ক্রিকেটের খুঁটিনাটি শিখেছেন ঠিক। তবে, চাচার জোরে জাতীয় দল অবধি যে উঠে আসেননি সেটি ব্যাট হাতে অভিষেকের চার বছর পরেও প্রমাণ করে চলেছেন। কঠোর পরিশ্রম আর সাধনার ফল তিনি হাতেনাতেই পাচ্ছেন। সফলতার চূড়ায় উঠতে হলে এভাবেই নিন্দুকদের কুশ্রীত্বকে আপন করে নিতে হবে। জবাবটাও দিতে হবে ইমামের মতই। বারংবার প্রমাণ করে যাবেন যে, তিনি স্বজনপ্রীতির জোরে আসেননি, এসেছেন যোগ্যতায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link