আমিরের পাপমোচনের শিরোপা জয়

চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনাল। দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী, রোমাঞ্চকর এক লড়াই; পাকিস্তানের অবিস্মরণীয় এক শিরোপা জয়। ফাইনালের আগ অবধি ম্যাচে ‘ফেভারিট’ ছিল ভারত। কারণ আইসিসি  টুর্নামেন্ট মানেই তো ভারতের কাছে পাকিস্তানের হার। আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে এর আগে ভারতকে হারাতে পারেনি পাকিস্তানীরা। সেবারও তাই ভারতীয় সমর্থকদের প্রত্যাশা ছিল পূর্বের ধারা বজায় রেখে পাকিস্তানকে ধরাশায়ী করে নিজেদের ঝুলিতে আরেকটি শিরোপা যোগ করবে ভারত।

তবে ভারতের সেই আশায় ‘গুড়েবালি’। সেদিন সবার প্রত্যাশা কিংবা ভাবনা ছাপিয়ে পাকিস্তানের সামনে ওভালে অসহায় আত্মসমর্পণ করে ভারত। জাসপ্রিত বুমরাহর নো বলে জীবন পেয়ে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানকে বড় সংগ্রহ এনে দিয়েছিলেন ফখর জামান। কিন্তু, সব ছাপিয়ে সেদিন ওভাল কাব্যের নায়ক বনে যান মোহাম্মদ আমির।

এই ইংল্যান্ডের মাটিতেই ফিক্সিং কান্ডে পাকিস্তান ক্রিকেটকে তিনি কলঙ্কিত করেছিলেন, মোহাম্মদ আসিফ, সালমান বাটদের সাথে যুক্ত হয়ে। সেই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে সাজাও কেটেছেন পাঁচ বছর। নিষেধাজ্ঞা শেষে বছর খানেক আগে দলে ফিরেছিলেন। তখন তিনি তীব্র সমালোচনার বাক্সে বন্দি। পাকিস্তান ক্রিকেটে কলঙ্কের দাগ লেপে দেওয়ায় দল থেকে বাদ দিতেও ফুঁসে উঠেছিল সমর্থকরা।

সব সমালোচনা আর নিন্দার ঝড় মাথায় নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পুনরায় ফিরেছিলেন আমির। বছরখানেক জাতীয় দলের জার্সিতে ভাল পারফর্ম  করে সুযোগও পেয়ে যান আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে।

সেবার পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফর্ম দেখিয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় পাকিস্তান। ইনজুরির কারণে সেমিতে খেলতে পারেননি আমির। সেমির বাঁধা টপকে ফাইনাল অবধি পৌঁছে যায় পাকিস্তান। অবশ্য ওই টুর্নামেন্টে আমিরের পারফরম্যান্স ছিল বড্ড সাদামাটা। প্রথম তিন ম্যাচে নিয়েছিলেন মোটে তিন উইকেট। তবু অভিজ্ঞতার বিচারে ফাইনালে সুযোগ পেয়ে গেলেন। নিজেকে প্রমাণের জন্য সেরা সুযোগ, সকল সমালোচনাকে বোতলবন্দি করে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার মোক্ষম এক সুযোগ। আর সেই সুযোগ দু’হাতে লুফে নিলেন আমির।

প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ফখর জামানের দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করায় পাকিস্তান। জাসপ্রিত বুমরাহর এক ভুলে পাকিস্তানের পাহাড়সম সংগ্রহ। ভারতের সামনে ৩৩৯ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা। এরপরই শুরু বল হাতে আমিরের  তাণ্ডব। যে তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয় ভারতের ব্যাটিং শিবির। আমিরের দুর্দান্ত এক স্পেলের সামনে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, শিখর ধাওয়ান – টপ অর্ডারের তিন সেরা তারকার কেউই দাঁড়াতে পারেনি।

ছয় ওভার দুই মেইডেন সহ ১৬ রানে তিন উইকেট। আমিরের বিধ্বংসী স্পেলের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভারতের টপ অর্ডার। ওই এক স্পেলে যেন আবার খোয়ানো সম্মান ফিরে পেলেন আমির। পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে পাকিস্তানি সমর্থকদের উল্লাস। প্রথমবারের মত আইসিসি টুর্নামেন্টে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জয় করেছে পাকিস্তান।

সমালোচনার কেন্দ্রে থাকা আমির এক স্পেলে বনে যান জয়ের নায়ক। খবরের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম – সর্বক্ষেত্রে চলছিল আমিরের ‘জাদুকরী’ স্পেলের প্রশংসা। নিন্দুকদের সমালোচনাকে এক স্পেলেই রূপ দিয়েছিলেন প্রশংসার বাণীতে। ওভালে ওই অবিশ্বাস্য এক স্পেলের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিলেন আমির। পুরো টুর্নামেন্টে বল হাতে সাদামাটা আমির ফাইনালের মঞ্চে দেখান অগ্নিঝড়া পারফরম্যান্স।

এক স্পেল, এক নতুন শুরু। নিজের সামর্থ্যকে নতুন করে জানান দেওয়া। যে মাটিতে দলের গায়ে কলঙ্কের দাগ এঁটে দিয়েছিলেন, সেই মাটিতেই দলকে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন আমির। বল হাতে সেদিন যেন কামানের গোলা ছুঁড়ছিলেন তিনি। ভারতের মনোবল নষ্ট করে দিয়েছিলেন একের পর এক আগুনের গোলার আঘাতে। স্যুইং, পেস আর নিঁখুত লাইন-লেন্থে হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। এক স্পেলে একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের টপ অর্ডার। শূণ্য থেকে আমির বনে গেলেন শিরোপা জয়ের নায়ক। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link