জীবনের ভারসাম্য ও একজন প্যাট্রিক ভিয়েরা

১৯৭২ সালের ২৩ জুন, ফ্রান্স ফুটবল ইতিহাসের সেরা মিডফিল্ডার জিনেদিন জিদানের জন্ম হয়েছিল। ঠিক একই তারিখে চার বছর পর ১৯৭৬ সালে পৃথিবীর আলো দেখেছিল ফ্রান্স ফুটবল-মাতার আরেক স্মরনীয় সন্তান। তিনি প্যাট্রিক ভিয়েরা, প্যাডি নামেও বেশ পরিচিত এই কিংবদন্তি মিডফিল্ডার।

জিনেদিন জিদানের মতই প্যাট্রিক ভিয়েরাও ফ্রান্সে একজন অভিবাসী। জন্মসূত্রে ভিয়েরা মূলত সেনেগালের নাগরিক। কিন্তু তার দশ বছর বয়সের সময় ভিয়েরা’র পরিবার কাজের খোঁজে সেনেগাল থেকে চলে আসে ফ্রান্সে। দরিদ্রতার পাশাপাশি ভিয়েরা’র ছোটবেলার সঙ্গী হয়েছিল বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ। ভিয়েরা’র শিশু বয়সেই তার বাবা পরিবার ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তবে ভিয়েরা’র মাতামহ ছিলেন ফ্রান্স সেনাবাহিনীর সদস্য আর তিনিই তাঁর নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করেছিলেন।

একেবারে শিশু বয়সেই পেশাদার ফুটবল হওয়ার ব্যাপারে মনস্থীর করেছিলেন প্যাট্রিক ভিয়েরা। ফুটবল পাগল ভিয়েরা ১৯৮৪ সালে এফসি ত্রাপেজ নামের একডেমিতে সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখান বছর দুয়েক থাকার পর এফসি ড্রোয়াইজ এর যুবদলের সাথে যুক্ত হয়েছিল ভিয়েরা। সেখানে পাঁচ বছর কাটানোর পর ১৯৯১ সালে ১৫ বছর বয়সেই তাকে দলে ভেড়ায় লিগ ওয়ানের দল ট্যুরস।

এরপর সতেরো বছর বয়সে তিনি ফ্রান্সের ক্যানস ক্লাবে যোগ দেন। সেখান নিজের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি নেতৃত্বগুণ দিয়ে নজর কেড়েছিলেন ভিয়েরা। আর তাই মাত্র দুই বছর পরেই ক্লাবের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব আসে ভিয়েরা’র ওপর। ইউরোপীয় বড় ক্লাবগুলোরও নজরে এসেছিলো প্যাট্রিক ভিয়েরা।

১৯৯৫ সালে ফ্রান্স ছেড়ে ইতালিতে চলে আসেন প্যাট্রিক ভিয়েরা। এইসময় এসি মিলানের স্কোয়াডে থাকলেও অধিকাংশ সময় সাইডবেঞ্চেই বসে থাকতে হয়ে ছিল এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে। তাই এরপরেই মিলান ছেড়ে আর্সেনালের সাথে ৩.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে চুক্তি করেন ভিয়েরা। মূলত ফরাসি আর্সেন ওয়েঙ্গার আর্সেনালের কোচ হয়ে আসায়, পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে ইংলিশ ক্লাবটিকে পছন্দ করেছিলেন ভিয়েরা।

এরপর ধীরে ধীরে গানার্সদের মধ্যমাঠের কেন্দ্র হয়ে ওঠেন প্যাট্রিক ভিয়েরা। দীর্ঘ নয় বছর এই ক্লাবের হয়ে খেলে গিয়েছিলেন তিনি। আর্সেন ওয়েঙ্গারের অন্যতম প্রিয় শিষ্য ছিলেন এই ফরাসি। বিশ শতকের শেষদিকে আর্সেনালের যে দাপট বিরাজমান ছিল তাঁর অনেকটুকু কৃতিত্ব ভিয়েরাকে দিতেই হয়।

ভিয়েরা-পেতিত জুটি আর্সেনালের মিডফিল্ডকে করে তুলেছিল একই সাথে বিধ্বংসী আর দুর্ভেদ্য। এছাড়া জিলবার্তো সিলভার সাথে ভিয়েরার মিডফিল্ড জুটিকে তো প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা জুটি বলা হয়।

আর্সেনালের হয়ে মোট ৩৯৭ ম্যাচ খেলে ৩২ গোলের পাশাপাশি ৪৪ টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন প্যাডি। এছাড়া গানার্সদের জার্সি গায়ে তিনটি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপাসহ এফএ কাপ এবং এফএ কমিউনিটি শিল্ড কাপ জিতেছিলেন তিনি।

২০০৫ সালে আর্সেনালের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ১৩.৭৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে জুভেন্টাস শিবিরে যোগ দেন ভিয়েরা। কিন্তু এর পরের বছরই ম্যাচ পাতানোর দায়ে জুভেন্টাসকে সিরি বি-তে রেলিগেট করা হয়। অত:পর জুভেন্টাস ছেড়ে ইন্টার মিলানে যোগ দিয়েছিলেন ভিয়েরা।

ইন্টার মিলানের সাথে ৯.৫ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের একটি চুক্তিতে চার বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন ভিয়েরা। এই চার বছরের সময়কালে দলটির হয়ে ৯২ ম্যাচ খেলে নয় গোল এবং ১০টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন। এছাড়া মিলানের চারটি সিরি ‘এ’ শিরোপা, একটি কোপা ইতালিয়া, এবং দুইটি সুপার কোপা জয়ে সরাসরি অবদান রেখেছিলেন ফরাসি কিংবদন্তি।

৩৪ বছর বয়সে পুনরায় ইংল্যান্ডে ফিরে ম্যানচেস্টার সিটির ডেরায় আশ্রয় নেন প্যাটট্রিক ভিয়েরা। সিটিজেন ফের হয়ে ৪৬টি ম্যাচ খেলা প্যাডি ছয়টি গোল করেছিলেন। আর ট্রফি বলতে জিতেছিলেন শুধুই একটি এফএ কাপ।

সবমিলিয়ে নিজের ক্লাব ক্যারিয়ারে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ক্লাবের হয়ে ৬৩৬ টি ম্যাচ খেলেছেন ভিয়েরা। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হওয়া সত্ত্বেও ৫৫ টি গোল এবং অ্যাসিস্ট করেছেন। এর বাইরে তো নিজের রক্ষণ সামলানোর দায়িত্ব পালন করেছেন একেবারে সবচেয়ে নান্দনিকভাবে।

জাতীয় দলে ফ্রান্সের হয়ে খেলেছেন প্যাটট্রিক ভিয়েরা। ১৯৯৭ সালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয়েছিল তার, এরপর দীর্ঘ সময় ধরেই ফরাসিদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ভিয়েরা। খেলেছেন জিনেদিন জিদানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন ভিয়েরা। এছাড়া ফিফা কনফেডারেশন কাপ জেতার স্বাদও পেয়েছেন তিনি।

খেলার মাঠ থেকে বিদায় নেয়ার পরেও ফুটবলকে ছাড়তে পারেননি ভিয়েরা। ২০১১ সালে বুটজোড়া তুলে রাখার পর তিনি ফিরেছিলেন ডাগআউটে। নিউইয়র্ক সিটির হয়ে দুই বছর কোচিং করানোর পরে স্বদেশী ক্লাব ‘নাইস’-এর কোচ হিসেবে বছরখানেক কাজ করেছেন প্যাডি। বর্তমানে তিনি আছেন ইংলিশ ক্লাব ক্রিস্টাল প্যালেসের দায়িত্বে।

ভিয়েরা ছিলেন একজন পরিপুর্ণ মিডফিল্ডার। দীর্ঘদেহ, দুর্দান্ত ট্যাকেলিং সেন্স, বল দখল করার অবিশ্বাস্য সক্ষমতা, স্কিল আর ভিশন মিলিয়ে ভিয়েরা তাঁর নিজের পজিশনে বিশ্বের সেরাদের একজন হয়ে উঠেছিলেন। তার ধারাবাহিক পারফরম্যান্স এবং মাঠের লড়াকু মনোভাব দ্রুতই ভক্তরা ভালবেসে ফেলছিল।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ওয়েইন রুনি, লিভারপুলে স্টিভেন জেরার্ড কিংবা চেলসিতে ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড যেমন, আর্সেনালে প্যাটট্রিক ভিয়েরা তেমনই। ইনভিন্সিবল আর্সেনাল দলের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন তিনি।

ফরাসি এই কিংবদন্তি আর্সেনালের হল অব ফেমেও জায়গা পেয়েছেন। দর্শকদের ভোটে হয়েছেন ক্লাবের সর্বকালের সেরা পাঁচজন খেলোয়াড়ের একজন। গানার্সভক্ত তো বটেই, সব ফুটবলপ্রেমীই এই আইকনিক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে মনে রাখবে আজন্ম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link