মুম্বাইকে হারিয়ে প্রথমবার রঞ্জি ট্রফির শিরোপা জয় করে মধ্যপ্রদেশ। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে ফাইনালে উঠলেও শিরোপা জিততে পারেনি চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের দল। সেই চন্দ্রকান্তের হাত ধরেই প্রথমবার শিরোপা জিতলো মধ্যপ্রদেশ। অধিনায়ক হিসেবে না পারলেও, কোচ হিসেবে ঠিক করে দেখিয়েছেন সাবেক এই ভারতীয় তারকা।
অবশ্য রঞ্জিতে এটি চন্দ্রকান্তের প্রথম শিরোপা নয়। কোচ হিসেবে ষষ্ঠবারের মত জিতেছেন রঞ্জির শিরোপা; রঞ্জির ইতিহাসের সবচেয়ে সফল কোচ হিসেবে ইতিমধ্যেই নাম কামিয়েছেন সাবেক এই ভারতীয় তারকা।
শিরোপা জয়ের ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে চন্দ্রকান্ত বলেন, ‘আমি কখনো কোনো খেলোয়াড়কে বলিনি ফ্রি থাকলে আমার রুমে এসো। আলাদাভাবে কিছু করিনি, সবই ছিল দলগত ভাবে। আমরা যদি কোনো একটা মিশন বা লক্ষ্য মাথায় রাখি, সেটা নিয়েই কাজ করেছি। পুরো মৌসুমে এটাই ছিল আমাদের রুটিন।’
এটাই যেন মধ্যপ্রদেশের এবারের রঞ্জি ট্রফি জয়ের মূল মন্ত্র ছিল। কোনো নোটবুক কিংবা সাদা বোর্ডে লিখে নয়, হোটেলের লবিতে সবাই এক হয়ে বসে মৌখিক ভাবেই সব পরিকল্পনা সাজানো থেকে শুরু করে সেটার উপর দলীয়ভাবেই আমল করা।
চন্দ্রকান্ত রাত-দিন সবসময়ই যেন দলের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। চেহারায় দেখা মিলতো না ক্লান্তির ছাপ। চন্দ্রকান্তের সফলতায় মুগ্ধ হয়েছেন সবাই, প্রশংসাও কুড়াচ্ছেন বেশ। দীনেশ কার্তিক তো রঞ্জি ট্রফির অ্যালেক্স ফার্গুসন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন চন্দ্রকান্তকে। ফার্গুসন ইংলিশ ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সফল একজন ম্যানেজার ছিলেন। এছাড়া সাবেক ভারতীয় অলরাউন্ডার ইরফান পাঠান বলেছেন, ‘যদি চন্দ্রকান্তের জেতা ছয়টি রঞ্জি ট্রফি আইপিএলে রূপান্তর করা যেতো!’
সাবেক ক্রিকেটার অভিনব মুকুন্দ তো মনে করেন চন্দ্রকান্তের কাছে জাদু আছে।
কোচ হিসেবে ২০০২-০৩ মৌসুমে মুম্বাইয়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফি জিতেন চন্দ্রকান্ত। এরপর ২০০৩-০৪ ও ২০১৫-১৬ তে একই দলের হয়ে শিরোপা জেতেন তিনি। ২০১৭-১৮ তে বিদর্ভকে প্রথমবার রঞ্জি ট্রফির শিরোপা এনে দেন তিনি। সেখান থেকে ২০২১-২০২২ মৌসুমে প্রথমবার তার অধীনে শিরোপা জেতে মধ্যপ্রদেশ।
২০২০ সালে কোচ হিসেবে মধ্যপ্রদেশের দায়িত্ব নেন চন্দ্রকান্ত। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ আমি আমার গ্রামে ছিলাম তখন, যখন মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সচিব সঞ্জিব রাও আমাকে ফোন করে। কেউ তাঁকে বলেছিল যে আমি ফ্রি আছি। আমি ভাবলাম আবার ফিরে যাওয়া যাক মধ্যপ্রদেশ। কারণ আমি তো এই দলের হয়ে ৬ বছর ক্রিকেট খেলেছি। আমার মনে হলো এই প্রস্তাবটা ঈশ্বরপ্রদত্ত ছিল।
এরপর মধ্যপ্রদেশের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন চন্দ্রকান্ত। রঞ্জি ট্রফির আগে প্রায় ১৫০টি সাক্ষাৎকার দেন তিনি! ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষাৎকারে প্রায় প্রতিটি খেলোয়াড়কেই তুলে ধরেছিলেন এই কোচ। ভেঙ্কটেশ আইয়ারকে ওপেনিংয়ে উঠিয়ে আনার পেছনেও অবদান চন্দ্রকান্তের।
তিনি বলেন, ‘আইয়ার ছয় নম্বরে ব্যাট করতো। ২০ রান করতো, ২৪ নট আউট থাকতো। এরপর আমি তাঁকে বলেছিলাম তুমি ওপেনিংয়ে সবচেয়ে ভাল করবে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, যদি আমি ব্যর্থ হই তাহলে কি হবে? আমি বললাম, আমি আছি কিছুই হবে না। এরপর বললো যদি টিকে যাই তাহলে কি হবে? আমি প্রতিত্তোরে বললাম, তাহলে তুমি তোমার জায়গা পাঁকা করে ফেলবে। আর এখন সে ভারতের হয়ে খেলছে।’
খেলোয়াড়দের নিজের পছন্দমতোই খেলার সুযোগ দেন চন্দ্রকান্ত। খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন সবসময়ই। সাবেক এই ক্রিকেটার বলেন, ‘আমি খেলোয়াড়দের প্রত্যেককেই তাঁদের পছন্দের পজিশনের কথা জিজ্ঞেস করেছি। আইয়ারের সাথে দুবে ওপেন করেছে। আদিত্য পাঁচে খেলতে চেয়েছে, তাঁকে সেখানেই সুযোগ দিয়েছি। শুভম শর্মাকে নিজে বলেছিলাম ওপেন করতে। সে বললো, সে তিনে খেলতে চায়। তাকেও সেখানে সুযোগ দিয়েছি। রজত পাতিদার তিনে খেলতে চেয়েছিল, বলেছি তুমি চারে খেলো এটা তোমার জন্য সবচেয়ে ভাল আর নিরাপদ জায়গা।’
দলে সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজন না করে সবাইকে একসাথে রাখাই ছিল চন্দ্রকান্তের উদ্দেশ্যে। সবার সাথেই যোগাযোগ রেখেছেন, সবার ভাল-মন্দ খোঁজ রাখতেন। মধ্যপ্রদেশের এই কোচ বলেন, ‘প্রায় সময় বোর্ডে কাউকে না কাউকে নিজেদের মন মত কিছু লিখতে বলতাম। আমি কাউকে জোর করিনি বা চাপ প্রয়োগ করিনি।’
এই স্টাইল বা কৌশল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাজে দিবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে চন্দ্রকান্ত বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের ওই ধরনের ম্যাচিউরিটি থাকা লাগে, যাতে সে সবকিছুই বুঝতে পারে আর সেভাবেই কাজ করে। ঘরোয়া ক্রিকেটে আসলে একজনই যথেষ্ট সবকিছু সামাল দিতে। আমার কোনো ব্যাটিং বা বোলিং কোচ ছিল না।’
চন্দ্রকান্তের মতে সফলতা আসে অনেক কিছু বিসর্জনের মাধ্যমে। শর্ট-কাট কোনো পদ্ধতিতে আসলে সফল হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘আমার মনে আছে, আদিত্য বিয়ের আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল স্যার তারিখ কখন দিব? আমি বলেছিলাম, অবশ্যই জুনে। আর ২-৩ দিনের বেশি সময় পাবে না তুমি; হানিমুনের জন্যও সময় পাবে না। কারণ আমরা প্রস্তুতি শুরু করবো। সেই থেকে আদিত্য এখন অবধি হানিমুনে যেতে পারেনি।’
মনে মনে খানিকটা হতাশ হলেও মধ্যপ্রদেশের তারকা ক্রিকেটার আদিত্য অবশ্য সেটি প্রকাশ করেননি। আর তাঁর মতই বাকিরাও চন্দ্রকান্তের মন্ত্র অনুসরণ করেই এগিয়েছে পুরো মৌসুম জুড়ে। যার ফলে সফলতা ধরা দিয়েছে শিরোপা রূপে। ২৩ বছর আগে অধিনায়ক হিসেবে যা করে দেখাতে পারেননি, সেটা একই মাঠে কোচ হিসেবে করে দেখালেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের কিংবদন্তি কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত।