হাউজ দ্যাট!

আধভাঙা আঙুল দিয়ে বলটাকে ঘুরিয়ে গুড লেংথের ওপর টানা বল ফেলে চলেছেন বছর তেইশের এক অফস্পিনার। ড্রপ দিয়ে আবার মিডল স্ট্যাম্পে ঢুকে পড়ছে বলটা। যাদুকরেরা এমনই হন বোধহয়! নিজের দুর্বলতাকে শান দিয়ে বোকা বানিয়ে যান সকলকে।

সে দর্শক হোন বা ব্যাটসম্যান। বিষাক্ত অফ-স্পিন গুলো না জানি কি করে এত্ত অনায়াসে মিডল স্ট্যাম্পটাকে খুঁজে ফেলে? ২০০৩ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকা। এমনই এক ভাঙা আঙুল। দুরুহ অফস্পিন আর নির্মম সব দুসরা। আর একজন ভাজ্জি।

দুই বছর আগে সৌরভের একটা ফোন কলে পাল্টে গেছে সবকিছু, যেন অসহায় ব্যর্থ জাদুকরের হাতে একটা মন্ত্রপুত যাদুকাঠি সেদিন তুলে দিয়েছিলেন সৌরভ! সিলেক্সন প্যানেলের চরম বিরোধিতার সামনে চওড়া অরিত্র হয়ে বছর একুশের অনভিজ্ঞ হরভজনকে দলে সামিল করেছিলেন। তারপরে সারা বেলা ধরে লেখা হয়েছে শুধু সোনালী ইতিহাস, ফিরে তাকাননি ভাজ্জি, ফিরে গেছেন অজস্র ব্যাটসম্যান। সৌরভের রাজসভায় এক উজ্জ্বল রত্ন হয়ে রয়ে গেছেন হরভজন সিং।

পাঞ্জাবিরা তেরঙার প্রতি একটু বেশীই আবেগী হয়ে থাকেন বরাবর। আর সেই আবেগ যদি দেশের জার্সী হয়ে থাকে তাহলে আর কোনো কথাই নেই, এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন এমন কেউ নেই বোধহয়।

সম্ভবত ১৯৯৭ সাল, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইন্ডিয়ান বোর্ড প্রেসিডেন্টস্ ইলেভেনের হয়ে গায়ে জার্সী চাপানোর মওকা এল ভাজ্জুর কাছে, বাবার স্বপ্ন ছেলে বড় ক্রিকেটার হোক। যথারীতি টিমের সাথে রওনা দিলেন হরভজন, প্রথম টেস্ট! দ্বিতীয় টেস্ট – প্লেয়িং ইলেভেনে নেই ভাজ্জি।

তৃতীয় বারে অভিষেক হল ভাজ্জির, কিন্তু সেবার মাত্র একটি উইকেট তুলতে পেরে কার্যত ব্যর্থই হয়েছিলেন হরভজন। সেই নির্বাচন প্যানেল থেকে ভাজ্জির নাম আস্তে আস্তে করে মুছে যাওয়ার শুরু। অনুর্ধ্ব-১৯ ও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ভালো ফল করলেও তখন বোর্ড কোনোমতেই ভাজ্জিকে নিতে নারাজ।

আত্মবিশ্বাসহীন, বিধ্বস্ত হরভজন তখন ক্রিকেট ছাড়বার কথা ভাবতেও পিছপা হননি, কিন্তু ততক্ষণে রতনে রতন চিনে ফেলেছেন। অধিনায়ক সৌরভ তখন লড়ে চলেছেন নির্বাচন কমিটির বিরুদ্ধে, এতক্ষণ ধরে যারা সৌরভের এই প্রস্তাবকে হেসে উড়িয়েছিলেন, অবাধ্য সৌরভ তাদের ওপরে সপাটে একটা ফিনিশিং টাচ দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন প্রায়। চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘হরভজন সিংকে না নিয়ে হল ছাড়ছি না আমি।’

ইডেন, ২০০১। ভাজ্জির অফ-স্পিন আর দুসরায় পন্টিং-গিলি-ওয়ার্নরা সারি বেঁধে ফিরে গেলেন পরপর তিনটি বলে, ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচে হ্যাট-ট্রিক নিয়ে সৌরভের ওইদিনের ললড়াইকে সফল প্রমাণ করার সফর শুরু হয়েছিল সেদিন থেকে।

তারপরে কুম্বলের গুগলির পাশে নিজের দুসরা মিলিয়ে বিজয়চূর্ণ ঝরিয়ে দিয়েছেন বারবার, সৃষ্টি করেছেন হাজারো ইতিহাস, কুম্বলের দুর্বোধ্য লেগস্পিন আর তাঁর বিষাক্ত অফস্পিন একসাথে কতই না লীলা দেখিয়ে গেছে! সৌরভের চলে যাবার পর নিষ্প্রভ চ্যাপেল জমানার মাঝেও দেখিয়েছেন স্পিন-যাদু।

খেলে গেছেন ২০০৩, ’০৭, ’১১ এর বিশ্বকাপ। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী থেকেছেন অনেকবার। শ’খানেক টেস্ট ম্যাচে চারশোর বেশি উইকেট তুলে নিয়ে আজও কুম্বলের পর ভারতের সবচেয়ে বড় স্পিন-সুপারস্টার হয়ে রয়েছেন ভাজ্জি।

আমাদের শৈশবের তিনশো পয়ষট্টি দিন এই ভাজ্জির দুহাত মেলে এগিয়ে এসে আঙুলের ফাঁক থেকে বলটা ঘুরিয়ে পিচে ছুঁড়ে দেওয়ার ছবি দেখে কেটেছে। ড্রপ করে বলটা ভেতরে ঢুকে পড়েছে বারবার, কখনও প্যাডে আছড়ে পড়লে কর্কশ শব্দে ভেসে এসেছে ‘হাউজ দ্যাট!’

বিদেশের মাটিতে ভাঙাচোরা পেস অ্যাটাকের পাশে ভারতের কাঁধের ওপর আস্থার হাত রেখেছে ভাজ্জির অফস্পিন। অজি-ব্রিটিশ শক্তির কদর্য স্লেজিং-এর সামনে বিধ্বস্তপ্রায় হয়ে পড়লে ভাজ্জির একটা সপাটে থাপ্পড় খোলা আকাশের গায়ে তেরঙা উড়িয়ে দিয়েছে বহুবার। ভারতীয় ক্রিকেটের চিরাচরিত উত্থান-পতনের ইতিহাসে ভাজ্জির ফিঙ্গারপ্রিন্টটা সাক্ষী হিসেবে খোদাই হয়ে রয়েছে টিম ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বুকে।

তাই তো ভাজ্জিদের ক্যারিয়ারের সূচনা রুপকথার গল্পের মতো হলেও সমাপ্তির বেলায় থাকে না কোনো আড়ম্বর কোনো সমারোহ। গোড়াপত্তন আর পরিসমাপ্তির মাঝে এইটুকুই তফাত বোধহয়। তবু ভাজ্জুরা এভাবে বাঁচতে চায় না তো, ভাজ্জুরা বেঁচে থাকে সবুজ গালিচার মাঝে বিছিয়ে দেওয়া ধুসর কার্পেটের ওপর, বেঁচে থাকে ধুসর কার্পেটের ওপর ফেলে দেওয়া একটা দুসরার ওপর ভর করে।

মহারাজ থেকে মাহি, দুই সভ্যতার জটিল বিজ্ঞানের মাঝে বলের সিমের ওপর শক্ত করে আঁকড়ে ধরা এই আঙুল দুটিই ছিল তাঁদের অদ্বৈত প্রত্যয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link