উজ্জীবিত তরুণ পেস-ব্যাটারি

সবুজে ঢাকা উইকেট। ছুটে আসা এক ফাস্ট বোলার। শরীর ধেয়ে আসা এক শর্ট বল। ধরাশায়ী ব্যাটার, বল উইকেটরক্ষকের হাতে। আগ্রাসী উদযাপনের ঢল।

না, দৃশ্যটা ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারির গল্প নয়। কিংবা ক্যারিবিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি উইকেটও নয়। দৃশ্যটা রাজশাহীর শহীদ কামরুজ্জামান স্টেডিয়ামের। আর বোলারটা হলেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী।

শুধু মৃত্যুঞ্জয় নয়, সাম্প্রতিক সময়ে তরুণ এক ঝাঁক পেসার নিয়মিতই এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দিচ্ছেন। অথচ, একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের কার্যকর ফাস্ট বোলারের অভাব ছিল প্রকট। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে দেশের পেস আক্রমণভাগে। ওটিস গিবসন এবং অ্যালান ডোনাল্ডদের হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছে পেস-বিপ্লব।

তাসকিন আহমেদ এক্ষেত্রে বিপ্লবের  অগ্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, এর পাশাপাশি সাদা বলে মুস্তাফিজ, শরিফুলদের সাথে লাল বলে আছেন ইবাদত খালেদরা। সবমিলিয়ে লাল-সবুজের ফাস্ট বোলাররা এখন অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ।

এখানেই শেষ নয়, পেস-বিপ্লবের অংশ হিসেবে নিজদের গড়ে তুলছেন পাইপলাইনে থাকা তরুন ফাস্ট বোলাররা। এদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী, মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ, রিপন মন্ডল এবং মুশফিক হাসান সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছেন। গত একবছর থেকে দেশের ঘরোয়া লিগগুলোতে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন এই তরুণেরা।

এই যেমন মুকিদুল মুগ্ধ, যার ছোটবেলা শুরু হয়েছে কৃত্রিম শ্বাসে বেঁচে থাকার মাধ্যমে। পায়ে পরতে হয়েছে লোহার বেড়ি, অথচ এখন নিজের ভাগ্য বদলে তিনি ঝড় তুলছেন বাইশগজে। সর্বশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ইনজুরি থেকে ফিরে এসে তুলে নিয়েছেন ১৯ উইকেট। বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলার সময় মুগ্ধতা ছড়ানো মুগ্ধ বর্তমানে জাতীয় দলের আশেপাশেই আছেন।

এছাড়া কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রাথমিক দলে ছিলেন তিনি। আপাতত খেলছেন বাংলাদেশ হাই পারফরম্যান্ট ইউনিটের একঝাঁক তরুন তুর্কির সঙ্গে। এসব কিছু নিজের যোগ্যতাতেই অর্জন করেছেন মুকিদুল।

অন্যদিকে মৃত্যুঞ্জয় তো পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংটা করতে জানেন ভাল মতোই। একজন ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হরহামেশা মেলে না, তাই লাইমলাইট সবসময় খুঁজে নেয় এই পেসারকে। প্রথমবারের মত আলোচনায় এসেছিলেন সর্বশেষ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) দিয়ে।

ডেথ ওভারে বুদ্ধিমত্তার সাথে বোলিং আর রান খরচের কৃপণতা দিয়ে নিজেকে প্রমান করেছিলেন বাঁ হাতি এই পেসার ৷ বল হাতে হ্যাটট্রিকও করেছিলেন বিপিএলের সেই আসরে, সদ্য সমাপ্ত এইচপি ইউনিট ও বাংলাদেশ টাইগার্সের মধ্যকার চারদিনের টেস্টেও নিজেকে উজাড় করে দিতে ভুল হয়নি তার।

ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ২০২০ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ মিশন একেবারেই ভাল হয়নি। সেই ব্যর্থ মিশনেই নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করেছিলেন রিপন মন্ডল। জায়গা করেছিলেন বিশ্বকাপের সেরা পেসারদের তালিকাতেও। এরপর ঘরোয়া টুর্নামেন্টেও ধরে রেখেছিলেন সেই ধারাবাহিকতা।

আরেক সম্ভাবনাময়ী তরুণ মুশফিক হাসান। মুশফিকুর রহিমের সাথে নামে মিল থাকায় ব্যাটসম্যান ভাববেন না। লালমনিরহাটের এই ক্রিকেটার বাইশ গজে গতির ঝড় তোলেন, কাঁপন ধরান ব্যাটসম্যানের বুকে। নিজের বোলিংয়ে নাকাল করছেন দেশসেরা ব্যাটারদের। ঘন্টায় ১৪০ কিমিতে বল ছোঁড়ার কাজটা ইতোমধ্যে ভালমতোই আয়ত্তে এসেছে উনিশ বছর বয়সী মুশফিকের।

এবার হাই-পারফরমেন্স ইউনিট এবং বাংলাদেশ টাইগার্সের মধ্যকার টেস্টে এই চার উদীয়মান পেসারকে একইসাথে খুঁজে নিয়েছে ক্যামেরার লেন্স। রাজশাহীর সবুজ পিচে একেকজন হয়ে উঠেছেন বিধ্বংসী। গতি আর সুইং তো ছিলই, বাতাসের ব্যবহারও দারুনভাবে করেছেন এই ইয়াং স্টাররা। পাশাপাশি মাথা ছুঁই ছুঁই বাউন্সারে পরীক্ষা নিয়েছেন বাংলা টাইগার্সের ইমরুল-নাইমদের।

সবুজ ঘাস, গতিময় সুইং, আর বাউন্সারের সাথে নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেন্থ – সবমিলিয়ে তাদের সবারই বোলিং স্পেল ছিল উপভোগ্য। ভরসা জুগিয়েছে একটি সোনালী ভবিষ্যতের। সাংবাদিক কিংবা সাধারণ দর্শকের পাশাপাশি উপভোগ করেছেন বিসিবির নির্বাচকরাও, তাদের মোহিত করেছে  এমন দুর্দান্ত ফাস্ট বোলিং; আশান্বিত হয়েছেন তারুন্যের শক্তিতে।

পেস-সহায়ক উইকেট পেলে আসলে কি করতে পারেন রিপন মুগ্ধরা তার একটি প্রদর্শনীই হয়ে গেলো রাজশাহীতে। আর সেই সুযোগ করে দেয়ার জন্য রাজশাহীর পিচ কিউরেটরও একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। অনুকূল পরিবেশ না পেলে হয়তো আড়ালেই থাকতে হতো এই তরুণ পেস-ব্যাটারিকে।

বাংলাদেশের পেস বোলারদের একটা স্বপ্নীল সময় যাচ্ছে। দেশে-বিদেশে সাদা কিংবা রঙ্গিন পোশাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পেসাররা এখন পারফর্ম করছেন অথবা বলা যায় পারফর্ম করার প্রক্রিয়া বেশ ভালোভাবেই শুরু করেছেন। তাদের ব্যাকআপ হিসেবে উঠে আসছেন মৃত্যুঞ্জয়, মুশফিকরা। মজবুত করছেন দেশের পেস শক্তিকে।

জাতীয় দলের রাডারে থাকা মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী, রিপন মণ্ডল, মুশফিক হাসানরা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের আগামী দিনের পেস আক্রমণকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়ার। উন্নতির এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার কোন ফাস্ট বোলারের সাথে পাল্লা দিয়েই বাইশ গজে ব্যাটসম্যানকে পরাজিত করার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠবেন তারা। আপাতত একটু যত্ন আর অনুকূল পরিবেশের ব্যবস্থা করে দেয়া প্রয়োজন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link