ছোট্ট ভাগ্নের ক্রিকেটে বড্ড আগ্রহ দেখে মামা তাঁকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিলেন। সেই টাকা থেকে ১৫০০ টাকা দিয়ে একটি ব্যাট কিনলো সেই ছেলেটি। তাঁর জীবনের প্রথম ব্যাট। স্মৃতি বিজড়িত সেই ব্যাটটি সযত্নে আজও রেখে দিয়েছেন তিনি। ছোট্ট সেই ছেলেটি বড় হয়ে বিখ্যাত ক্রিকেটার বনেছেন।
আজ তাঁকে একনামে সবাই চেনে। নাম তাঁর বাবর আজম। হ্যাঁ, গল্পটা পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বাবর আজমের। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ বাবরের নামের সাথে যার মিল রয়েছে। বাদশাহ বাবর তো জন্মেছিলেনই শাসকের ঘরে, স্বভাবতই শাসকের পুত্র ভবিষ্যৎ শাসক হবেন তাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই যুগের বাবর আজম জন্মেছেন পাকিস্তানের নিতান্ত এক সাধারণ পাঞ্জাবি মুসলিম পরিবারে।
বাবরের ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে তাঁর ক্রিকেটপ্রেমী পিতার। নিতান্ত সাধারণ এই পিতা নিজে না খেয়ে ছেলের খাবারের যোগান দিতেন। তাঁর অর্থ ছিল না। কিন্তু ছেলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে বাবরের বাবা তাঁর বেশিরভাগ ম্যাচেই উপস্থিত থাকতেন। বাবর বলেন, ‘এখনও, আমার মাঝে বাবার ভয় আছে। আমি যদি বাজে শট খেলতাম, বাবা আমাকে বকা দিত!’
আর এই ব্যাপারটা বাবরকে ভাল খেলতে ও ফোকাস ধরে রাখতে মারাত্মকভাবে সাহায্য করেছে বলে তিনি মানেন। কে জানে, করাচিতে ৬৬ বলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১১০ রানের ইনিংস খেলার সময়ও হয়তো সেই বকার ভয়টাই কাজ করছিল তাঁর। সাম্প্রতিক অফ ফর্মের সময় যে পরিমান সমালোচনা হয়েছে – সেটা ওই বকার থেকে কম কিসে।
১৯৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করা এই ক্রিকেটার বর্তমানে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের তিন ফরম্যাটের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যে যোগ্য অধিনায়ক সেই ছাপটা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রাখলেন বেশ সু-নিপুণভাবে। কিন্তু নেতৃত্বের পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সকে ধরে রেখেছেন কঠোর হাতে। নিজেকে পরিণত করেছেন বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটার হিসেবে।
২০১৮ এবং ২০১৯ সালের সময়কালে তিনি পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ টেস্ট রান সংগ্রাহক ছিলেন। আবার ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৯ সালে পাকিস্তান দলের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন বাবর আজম।
এমনকি ২০১৭ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টি-টোয়েন্টি রান সংগ্রাহক এবং ২০১৯ সালে পাকিস্তান দলের হয়ে শীর্ষ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের বর্ষসেরা একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার নির্বাচিত হন এবং ২০১৮ সালে টি–টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকে বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে তিনি বিরাট কোহলিকে ছাড়িয়ে ওডিআইতে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটারের মর্যাদা লাভ করেছেন।
বাবরের স্বকীয়তা হল তিনি বীরেন্দ্র শেবাগের মত করে সামনে ঝুঁকে খুব ভাল স্পিন মোকাবেলা করতে পারেন এবং ভিভিএস লক্ষণের মত ব্যাকফুটেও ভাল খেলতে পারেন। এইতো গল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মধ্যকার প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে চরম ব্যাটিং ধ্বসের মাঝেই ঠিক দুর্গের ন্যায়ই পাকিস্তানকে আগলে ধরে রেখেছিলেন বাবর আজম।
পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে ১১৯ রান করেছেন এবং দ্বিতীয় ইনিংসেও ৫৫ রান করে পাকিস্তানের জয়ের পথে বিশাল অবদান রেখেছেন। আর বাবারের পারফরম্যান্স তাঁকে রেকর্ডবুকে জায়গা করে দিয়েছে। পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম ইনিংস খেলে ১০ হাজার রানের গণ্ডি পার করলেন বাবর। জাভেদ মিয়াঁদাদকে টপকে গিয়েছিলেন তিনি। আবার করাচিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি হয়ে উঠলেন বীরেন্দ্র শেবাগ।
২০২২ সালের এশিয়া কাপের পর বাজে একটা সময় যাচ্ছিল। পাকিস্তানের অধিনায়কের ব্যাট হাসছিল না একদমই। টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে, বাবর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন – কেন তিনি বাদশাহ, কেন তিনিই আধুনিক ব্যাটিংয়ের নাম্বার ওয়ান। এরপর আবার অপেক্ষা। সময়টা ভাল চলতে চলতে আবারও দু:সময়। বিশ্বকাপের সময়টায় তাঁকে খুব দরকার যখন পাকিস্তানের – তখনই তিনি ছন্নছাড়া – খেলছেন যেন নিজের ছায়া হয়ে।
বাবর মাঠে নামবেন এবং ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাট করে যাবেন- এ যেন খুব একটা চিরচেনা দৃশ্য। সেই চেনা দৃশ্যটা এবার এশিয়া কাপেও থাকছে। মহাদেশীয় লড়াইয়ে আবার পুরো বিশ্ব শাসনের দায়িত্বটা ফিরে পেলেন বাবর। এই ধারাবাহিকতা থাকলে পাকিস্তানের বাবর সাম্রাজ্যের মুকুটে আরেকটা পালক যোগ হতে বাধ্য।