অ্যান্ডারসন নাকি ডেল স্টেইন কে এই প্রজন্মের সেরা বোলার ছিলেন—এমন তর্ক প্রায়শই হয়। অস্ট্রেলিয়ার প্যাট কামিন্স একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, ২০ বছর ধরে ফাস্ট বোলিংয়ের মানদণ্ডটা ঠিক করে দিয়েছেন স্টেইনই।
তাঁর বোলিং এর প্রতিটি ডেলিভারি যেন ছিল এক একটি গুলি। যে গুলির আঘাতে জর্জরিত হতে হতো প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটারদের। স্টেইন-গান কে নির্ভয়ে, বুক ফুলিয়ে মোকাবেলা করতে পারতো ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন কোন ব্যাটার সম্ভবত ছিলেন না। কারণ স্টেইন ছিলেন নিঁখাদ এক ধ্বংসযজ্ঞের নাম।
ডেল স্টেইন ছিলেন একজন সত্যিকারের দুর্দান্ত ফাস্ট বোলার যার বিশেষত্ব ছিল তীব্র গতি, স্মুথ অ্যাকশন, এবং অবশ্যই অব্যর্থ নিশানা। টেস্ট ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কম টেস্ট খেলেই ১০০ টি উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়া বোলার তিনি।
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তাঁর ক্যারিয়ারের পনেরতম টেস্টেই তিনি তাঁর বিধ্বংসী রূপ দেখিয়েছেন এবং মাত্র ৯১ রানের বিনিময়ে ১০ টি উইকেট নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাটারদের সতর্কবাণী দিয়েছিলেন। স্টেইনের বাউন্সার ব্যাটারের শুধু হেলমেটই না আত্মবিশ্বাসও নড়িয়ে দিতে সক্ষম ছিল।
মরনে মরকেল এবং মাখায়া এনটিনির সাথে স্টেইন দারুণ বোলিং জোট গঠন করতেন। মরনে মরকেল, মাখায়া এনটিনি ও ডেল স্টেইন এই ত্রয়ীর কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং সাইড অনেক শক্তিশালী ছিল। তিনি যখন ২০০৪ সালের শেষের দিকে অভিষিক্ত হয়েছিলেন, প্রোটিয়ারা ইংল্যান্ডের কাছে ঘরের মাঠে হেরে গিয়েছিল সেবার।
অন্যদিকে ২০০৮ সালে যখন স্টেইনের ক্যারিয়ার শক্তপোক্ত হলো তখন প্রোটিয়ারা নিজেদেরকে টেস্ট সার্কিটে সেরা দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কারণ দক্ষিণ অফ্রিকার স্টেইন নামক একজন সর্ব-কন্ডিশন্ড ফাস্ট বোলার ছিলেন, যিনি যে কোনও জায়গায়, যে কোন পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে সক্ষম ছিলেন। স্টেইনের ক্যারিয়ারে সেরা স্পেলের অভাব নেই। স্টেইন ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা বোলার। সব মিলিয়ে তিনি তাঁর ক্যারিয়ারে প্রায় সাত বছর টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর বোলার ছিলেন।
অন্যসব ফাস্ট বোলারের মতোই চোট ভুগিয়েছে স্টেইনকেও। ২০১৬ সালে তাঁর কাঁধের চোট ছিল তাঁর ক্যারিয়ারকে থমকে দেওয়ার মতোই। এরপর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে টেস্ট খেলেননি তিনি। এরপর ফিরে আসলেও বারবার চোটের সমস্যা ভুগিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার এই বোলারকে।
ক্যারিয়ারে মোট ১২৫টি ওয়ানডে খেলেছেন স্টেইন। ওয়ানডেতে স্টেইনের উইকেট–সংখ্যা ১৯৬টি। পাশাপাশি ৪৭টি টি–টোয়েন্টিতে নিয়েছেন ৬৪ টি উইকেট। আর সর্বমোট ৯৩ টি টেস্ট ম্যাচে নিয়েছিলেন ৪৩৯ টি উইকেট। তাছাড়া ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক লিগ ও ঘরোয়া টি–টোয়েন্টি লিগেও নিয়মিত মুখ ছিলেন স্টেইন।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস বলে, প্রতি ৭০ বলে এই পেসার একটি করে উইকেট নিয়েছেন। ৯৩ টেস্টে নেয়া ৪৩৯ টি উইকেটের প্রতিটি নিতে তার খরচ করতে হয়েছে মাত্র সাত ওভার। যেখানে অন্যান্য বোলারদের খরচ করতে হয় প্রায় ১২ ওভার।
স্টেইন ২০১৯ সালেই টেস্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। ক্যারিয়ারের সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেছেন ২০১৯ সালের মার্চে এবং সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি খেলেছিলেন ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে। ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট সবধরনের ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানিয়েছিলেন ডেল স্টেইন।
ফাস্ট বোলিংয়ের অনুপ্রেরণা ডেল স্টেইন। ১৮ বছর বয়সে ফাস্ট বোলিং শুরু করা স্টেইনের অনুপ্রেরণায় ছিল ব্রেট লি’র মতো রান-আপ, অ্যালান ডোনাল্ডের মতো জাম্পিং স্টাইল, শোয়েবের মতো গতিদানব, শন পোলকের মতো সঠিক লাইন লেন্থ মেনে বোলিং করে যাওয়া। তাঁর বোলিং বরং এই চারজন বোলারের গুণের সংমিশ্রণ তো ছিলই, কিন্তু তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন তাদেরও ছাড়িয়ে অনন্য এক উচ্চতায়। যেখানে তিনিই সেরা, ক্রিকেট বিশ্বের একমাত্র স্টেইন-গান!