আইপিএল প্লটে উঁকি দেওয়া বিপ্লব

‘ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট’ – এই উক্তি শুনেই তো বড় হওয়া। ক্রিকেটের প্রেমে পড়া, ক্রিকেটকে বুঝতে শেখা, টেস্ট ক্রিকেটের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা। তবে একটা শঙ্কার উদয় হয়েছে পূব আকাশে। আধুনিক ক্রিকেট সম্পূর্ণ বদলে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা নিয়েই পুরো ক্রিকেট মহলে চাপা একটা দুশ্চিন্তা বিরাজমান। দিন দিন ঠিক কোনদিকে হাঁটছে ক্রিকেট সে চিন্তায় প্রায় অস্থির কিংবদন্তি খেলোয়াড়রা।

এর পেছনে মূল কারণ ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট। জমকালো সব আয়োজনে ছেয়ে যাচ্ছে পুরো ক্রিকেট। দেশ থেকে দেশান্তরে সবারই পরিকল্পনার উপরের দিকেই থাকছে একটি করে ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আয়োজন করা। সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড নিজেদের এক ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট আয়োজনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। অস্ট্রেলিয়ার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ওয়ানডে সিরিজ বাতিল করেছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড।

সে সিরিজটার সাথে ২০২৩ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার মহামূল্যবান পয়েন্ট সম্পৃক্ত ছিল। ওয়ানডে সুপার লিগে দক্ষিণ আফ্রিকা খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। এমন পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ এক সিরিজ বাতিল করাটা নিজ পায়ে কুড়াল মারার সমান। তবে এটার পেছনে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের যুক্তি তাঁরা ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের সময় তাঁদের জাতীয় দলের সব খেলোয়াড়কে ‘ফ্রি’ রাখতে চান।

এই বিষয়টাই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ডেভিড ওয়ার্নার বিগ ব্যাশ না খেলে ভিনদেশি আরেক ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে খেলার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। এই নিয়ে আবারও সরব ক্রিকেট দুনিয়া। ক্রিকেটের গতিপথ যেন আন্দাজ করে নেওয়া যাচ্ছে খুব সহজেই। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রভাবে ফিঁকে হতে শুরু করবে আন্তর্জাতিক দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলো।

সেটাই যেন অবধারিত। কেননা বর্তমান সময়ে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট যেন অর্থের খনি। পারফর্ম করা খেলোয়াড়দের নিজেদের করে নিতে যেন ফ্রাঞ্চাইজিগুলোর কোন কমতি বা কার্পণ্য থাকে না। তবে ফ্রাঞ্চাইজিরা এখন যেন ঢেলে সাজাতে চাইছেন তাঁদের সব পরিকল্পনা। উদাহরণ হিসেবে ভারতের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ফ্রাঞ্চাইজি নাইট রাইডার্সের কথাই ধরা যাক।

বর্তমানে তাঁদের দুইটি দল রয়েছে ভিন্ন দুই ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে। আইপিএলের কলকাতা নাইট রাইডার্সের পাশাপাশি ক্যারিবীয়ান প্রিমিয়ার লিগে ত্রিনবাগো নাইট রাইডার্স। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ ক্রিকেটের দুইটি দলও তাঁদের ছায়াতলে রয়েছে বলে জানা যায়। ফ্রাঞ্চাইজিরা নিজেদের বিস্তারটা ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছুক পুরো দুনিয়া জুড়ে।

ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হওয়া গেছে আইপিএলের ছয় ফ্রাঞ্চাইজির দখলে চলে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিতব্য ফ্রাঞ্চাইজি লিগের ছয় দল। এখন ফ্রাঞ্চাইজিদের ইচ্ছে তাঁরা যেন ১২ মাসের জন্য একজন খেলোয়াড়কে চুক্তিবদ্ধ করতে পারেন। এতে করে তাঁরা বিভিন্ন লিগে বিভিন্ন সময়ে খেলোয়াড়দের খেলাতে পারবেন। বিষয়টা খানিকটা ফুটবলের ক্লাব ফুটবলের আকার ধারণ করবে।

তবে এখানে ভিন্নতা থাকবে টুর্নামেন্টে। বিশ্বের যেকোন প্রান্তের যেকোন ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে ফ্রাঞ্চাইজিটি চাইলেই তাঁর সাথে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়কে খেলাতে পারবে। এতে করে খেলোয়াড়দের অর্থ উপার্জন যেমন বেড়ে যাবে সে সাথে ফ্রাঞ্চাইজিগুলোর ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে উঠবে। তাছাড়া ফ্রাঞ্চাইজিগুলো তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একটা নির্দিষ্ট ছক এঁকে ফেলতে পারবে। এমন ইচ্ছের কথা যেন আন্দাজ করে নেওয়া যায় নাইট রাইডার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ভেঙ্কি মাইশোরের বক্তব্য থেকে।

এতে করে আইপিএলে চারজনের বেশি বিদেশি ক্রিকেটার খেলানো না গেলেও বাকিদের সুযোগ করে দিতে পারবে ভিন্ন কোন লিগে। এতে করে খেলোয়াড়দের পেছনে খরচ করা অর্থে উসুল করতে পারবে ফ্রাঞ্চাইজিগুলো। মূলত ফ্রাঞ্চাইজিদের প্রচুর পরিমাণ অর্থের প্রলোভনের কারণেই খেলোয়াড়দের আগ্রহ বাড়ছে ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের জন্য। আর সে সুযোগটাই লুফে নিতে চাইছে বিশ্বের নানা প্রান্তের বড় বড় ব্যবসায়ীরা।

এমনটা হলে জাতীয় দলের হয়ে ক্রিকেট খেলার গুরুত্ব পরিসীমিত হবে। আসলে কেই বা না চাইবে একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। খেলোয়াড়দের দোষারোপ করবারও খুব বেশি সুযোগ তো এখানটায় নেই। ক্রিকেট বোর্ডগুলোকে আরও খানিকটা অর্থকড়ির দিক থেকে পুষ্ট হতেই হবে। তবুও ব্যবসায়ীদের অঢেল অর্থের বিপক্ষে কতটুকু টিকে থাকা যাবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বছরে একবার কিংবা চার বছরে একবার হওয়া আইসিসির টুর্নামেন্টের জন্যই অপেক্ষা করতে হবে। আর টেস্ট ক্রিকেট হয়ত কেবল ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়ে যাবে। অথবা জুন-জুলাইয়ের সময়টায় অমাবস্যার চাঁদের মত করে দেখা মিলবে লাল বলের ক্রিকেটের। ক্রিকেটটা হয়ত ছড়িয়ে যাবে, তবে ক্রিকেটের সেই গৌরবটা হয়ত মলিন হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link