এরিক টেন হ্যাগ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রেড ডেভিল সমর্থকরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। তারা ভেবে ছিলেন এবার বুঝি দলের অবস্থা ভাল হবে কিন্তু হায়! ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ম্যাচে ওল্ড ট্রাফোর্ডে, ব্রাইটনের কাছে হারার পর দেখা যাচ্ছে রেড ডেভিলরা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে।
হতাশ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকদের জন্য ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতার ‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?’ লাইনটি একদম সময়োপযোগী। ২০১৩ সালে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ম্যানেজারের দায়িত্ব ত্যাগ করার পর থেকেই তারা অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছেন।
দলবদলের বাজার বন্ধ হতে আর মাত্র তিন সপ্তাহের কিছু কম সময় বাকি কিন্তু নতুন ম্যানেজার টেন হ্যাগ এখনো নিজের সিস্টেম অনুযায়ী সব খেলোয়াড় পাননি। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের পর যারাই রেড ডেভিলদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাদের সবার একটাই কথা ছিল নিজেদের ‘প্রথম পছন্দ’কে তাঁরা দলে ভেড়াতে পারেননি যার কারণ হিসেবে অনেকেই ইউনাইটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এড উড ওয়ার্ডকে দায়ী করেন।
টেন হ্যাগ দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংকে নিজের এক নম্বর টার্গেট হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি তাকে ঘিরেই দল সাজাতে চান তাই দলবদলের বাজার খোলার আগে থেকেই রেড ডেভিলরা এই ট্রান্সফার সম্পন্ন করার জন্য তোড়জোড় শুরু করেন।
ক্লাবের নতুন প্রধান নির্বাহী রিচার্ড আর্নল্ড এবং স্পোর্টিং ডিরেক্টর জন মারটো প্রায় ১৩ সপ্তাহ ধরে সমঝোতা করেও ট্রান্সফারটি সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই খুব শিঘ্রই ফ্রেড ম্যাকটোমিনের মিডফিল্ড থেকে রেড রেভিল সমর্থকদের মুক্তি নেই যদিও আদ্রিয়ান রাবিওটকে দলে টানতে ক্লাবটি আগ্রহী বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ফুটবলার হিসেবে রাবিওট প্রথম একাদশের মাণ বাড়াবেন নি:সন্দেহে, তার মত বাম পায়ের একজন ফুটবলার টেন হাগ খুঁজছিলেন যে শারীরিক ভাবে শক্তিশালী এবং বলটা মিডফিল্ড থেকে অ্যাটাকিং থার্ডে নিয়ে যেতে পারবেন। তবে ইতিহাস বলছে এই ফ্রেঞ্চ ফুটবলারের কারণে দলে নানান সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে যা হয়ত রেড ডেভিলরা চাইবে না।
এছাড়া বোনাস হিসেবে থাকবেন তার এজেন্ট যিনি তার আপন মা, নানান সময় বিতর্কিত সব মন্তব্য করে খবরে এসেছেন তিনি। ইউরো ২০২০ থেকে ফ্রান্স বিদায় নেওয়ার পর এমবাপ্পে এবং পগবার মাকে তিনি বলেন যে তাদের ছেলেদের খারাপ খেলার কারণে ফ্রান্স টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পরেছে।
এ তো গেল মিডফিল্ডের খবর আক্রমনভাগের অবস্থা আরও ভয়াবহ। একের পর এক খেলোয়াড়ের সাথে নাম জড়ালেও কাওকেই দলে ভেড়াতে পারেনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। অ্যান্থনি, সেস্কো, আরনাটোভিচের পর রেড ডেভিলরা এখন আলভারো মোরাটা এবং কোডি গ্যাকপোকে দলে ভেড়াতে আগ্রহী বলে খবর শোনা যাচ্ছে।
স্কাই স্পোর্টস ইউকের সূত্র অনুযায়ী পিএসভির তরুণ ফুটবলার গ্যাকপোকে দলে নিতে তারা বেশ আগ্রহী যদিও ডি ইয়ং ট্রান্সফার সম্পন্ন হলে বাজেট ঘাটতির কারণে তা নাও হতে পারে। এছাড়া বোঝার উপর শাকের আঁটির মত ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর দল ছাড়ার আবদার তো আছেই।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পুরো বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত একটি ক্লাব। তারা অনেক বড় একটি নাম এবং ব্র্যান্ড হিসেবেও তাদের ভাল ওজন আছে। তাহলে তারা কেন পছন্দের ফুটবলারদের দলে ভেড়াতে পারছে না ? তাদের ওয়েজ বিল দেখলে বোঝা যায় আর্থিকভাবে ইউরোপিয়ান টপ লেভেলের ফুটবলারদের দাবি তারা খুব সহজেই মেটাতেই পারে তাহলে সমস্যাটা কোথায়? প্রশ্নগুলো উঠতেই পারে।
২০২২-২৩ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোয়ালিফাই করতে পারেনি। এই মৌসুমে তারা ইউরোপা লিগ খেলবে। টপ লেভেলে খেলা ফুটবলারদের স্বপ্ন থাকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলা তাই এই কারণে অনেক খেলোয়াড় ওল্ড ট্রাফোর্ডে আসতে অনীহা প্রকাশ করছে। এছাড়া নিকট অতিতে তাদের কর্মকাণ্ড ক্লাব হিসেবে তাদের কোন সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই এই কথাই বার বার প্রকাশ করেছে।
‘তাদের সুস্পষ্ট কোন ট্রান্সফার প্ল্যান নেই। তারা কাকে কিনছে, কেন কিনছে তা পরিস্কার নয়, তাদের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে’, স্যার আলেক্স ফার্গুসন দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফুটবল বিশ্লেষকরা বরাবরই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সম্পর্কে এই কথাগুলো বলে আসছেন। দলের ট্রান্সফার কমিটি এবং কোচিং স্টাফে পরিবর্তন এলেও রেড ডেভিলদের জন্য এখনো এই কথাগুলো প্রযোজ্য। আর তাদের পছন্দের খেলোয়াড় দলে না টানতে পারার অন্যতম কারণও বটে।
আপনি যখন শীর্ষ পর্যায়ের কোন খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে চাইবেন প্রথমে তার কাছে দলের ফিউচার ভিশন কি সেই সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে হবে, সবাই তো আর শুধু টাকার জন্য আপনার দলে ভিড়বে না তারা দেখতে চাইবে ক্লাবের পরিকল্পনা কি আর এখনেই দল হিসেবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আস্থা হারিয়েছে।
স্বল্প মেয়াদী সমাধান খুঁজতে গিয়ে তারা যাকে পেয়েছে তাকেই দলে নিয়েছে এবং ম্যানেজারের ও দলের বারোটা বাজিয়েছে। দলের কাঠামো অনুযায়ী সঠিক খেলোয়াড় না কিনে বরং বাণিজ্যিকভাবে তা লাভজনক কিনা সেটাই আগে বিবেচনা করেছে যার বড় উদাহরণ হল রোনালদো এবং সানচোর ট্রান্সফার, যেখানে দলের দরকার ছিল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার তা না কিনে আনা হল অ্যাটাকার।
ম্যানেজারের দাবি অনুযায়ী খেলোয়াড় কিনলে দলের চেহারা কিভাবে বদলে যায় তার বড় উদাহরণ হল লিভারপুলের ইয়ুর্গেন ক্লপ। ক্লপের দাবি অনুযায়ী রিক্রুটমেন্ট করে ‘হিস্টোরি ক্লাব’ তকমা পাওয়া লিভারপুল আবার তার সোনালী দিনে ফিরে গিয়েছে।
টেন হাগ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দায়িত্ব নিয়েছেন খুব বেশি দিন হয়নি। তার খেলার সিস্টেম অনুযায়ী দল তৈরির জন্য তাকে সময় দিতে হবে, তবে তাকে যদি তার পছন্দ অনুযায়ী খেলোয়াড় না দেওয়া হয় তাহলে আবারো পুরানো গল্পটের পুনরাবৃত্তি হবে। রেড ডেভিলরা যতই ম্যানেজার পরিবর্তন করুক দলের কাঠামো তৈরির জন্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট না পেলে ক্লপ কিংবা গার্দিওলাও এখানে এসে ব্যর্থ হবেন।