এক জাতি, এক নেতা!

২০০৫ সালে জর্জ বুশের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনায় আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর এই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রথম যিনি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, তিনি আর কেউ নন – ডিয়েগো ম্যারাডোনা! এই ক্ষুদে জাদুকরই তখন জর্জ বুশকে ‘হিউম্যান গার্বেজ’ উল্লেখ করে আর্জেন্টিনায় আন্দোলনের ডাক দেন।

হাজার হাজার মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নেয়, স্টেডিয়ামে গণজমায়েত হয়। যদিও শেষ অবধি ম্যারাডোনা আন্দোলনে থাকতে পারেন নি, কিন্তু ডাক তো তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন। আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগোস শ্যাভেজ!

ম্যারাডোনা ছিলেন ফুটবল একাদশের নেতা। কিন্তু ফুটবলটাই তো আর গোটা জীবন নয়। ফুটবলারদেরও তাই নামতে হয় জীবনের মাঠে, তুলতে হয় জোরদার কণ্ঠ! পেলে বা মাইকেল জর্ডানকেই দেখুন না!

১৯৯০ সালে মাইকেল জর্ডান নর্থ ক্যারোলিনার সিনেট নির্বাচনে কৃষ্ণ বর্ণের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নেতা হার্ভে জায়ান্ট কে সমর্থন করেননি। যদিও জায়ান্টের প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান জেসি হেমস কৃষ্ণবর্ণের মানুষের বন্ধু ছিলেন না বলেই প্রচলিত ছিল।

ডিয়েগো ম্যারাডোনাও ছিলেন লাতিন রাজনীতিতে সোচ্চার। সরাসরি ভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা হয়তো এই লাইনকে প্রমাণ করেনা, কিন্তু বিগত ৩০ বছর ধরে লাতিন রাজনীতির নানা উত্থান পতনের কালে ডিয়েগোর সোচ্চার থাকা আমাদের একটা নির্দিষ্ট বার্তা অবশ্যই দেয়।

১৯৭৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ম্যারাডোনা যখন পেশাদার ফুটবল শুরু করেন, আর্জেন্টিনা তখন সেনা শাসনে নিমজ্জিত। ম্যারাডোনার ভাষায় সে সময় তার রাজনীতির জন্যে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। তা রাজনীতির জন্যে ম্যারাডোনার সময় থাকুক বা না থাকুক, ম্যারাডোনার জন্যে রাজনীতির সময় সব সময়ই বরাদ্দ ছিল। যার প্রমাণ পাওয়া যায় আরো পরে, যখন তিনি এক সময়ের সেনা শাসক জেনারেল গালতিয়েরিকে আলিঙ্গন করেন।

১৯৭৯ সালে যুব বিশ্বকাপ জেতার পরও ম্যারাডোনা রেডিওতে এসে সেনা শাসকদের সমর্থনে কথা বলেন। যার প্রমাণ হিসেবে ম্যারাডোনার আত্মজীবনী লেখক জিমি বার্নসের ভাষ্যই যথেষ্ট।

নানা সময়ে রাজনীতিতে ম্যারাডোনার অংশ নেওয়া প্রশ্ন উঠিয়ে দিয়েছিল, ম্যারাডোনা ঠিক কোন ভাবধারার রাজনীতিকে সমর্থন করেন? ডান রাজনীতি নাকি ল্যাটিন ভাবধারার বাম রাজনীতি । ম্যারাডোনা নিজেকে বলেছেন একজন জাতীয়বাদী হিসেবে। সেই ছোট্ট বয়সে গালতিয়েরিকে আলিঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে তিনি সেনা শাসনেই প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘এই দেশের জন্যে সেনা শাসন লাগতোই।’

১৯৮২ সালে যখন আর্জেন্টাইন সেনাবাহিনী ব্রিটেনের সাথে ফকল্যান্ড আইল্যান্ড নিয়ে যুদ্ধে, ম্যারাডোনা তখন বিশ্বকাপে। তখনও সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও তিনি দৃপ্তভাবেই সমর্থন জানিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন সেনাবাহিনীর। সেই ঘটনার চার বছর পর তিনি ব্রিটেনকে যখন হারিয়ে দিলেন ‘ঈশ্বরের হাতে’, ম্যারাডোনা ৮৬ থেকে ফিরে গেছিলেন ৮২ তেই, ‘আমার এমন লাগছিল যেন আমি কোন ফুটবল দলকে নয়, হারিয়ে দিয়েছি গোটা এক দেশকেই!’

ফুটবল ছাপিয়ে এভাবেই আর্জেন্টাইন জাতীয়তাবাদের চর্চা করতে তিনি!

ম্যারাডোনা তাঁর আত্মজীবনীতেও লিখে গেছেন, ‘আমরা বারবারই বলেছি, ফুটবল মালভিয়ান যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু তাঁরা সেখানে আর্জেন্টাইন ছেলেদের পাখির মত গুলি করে মেরে ফেলেছে। আর এটা ছিল আমার পক্ষ থেকে এক রকম প্রতিশোধ।’

এমনকি একজন ফুটবলার হিসেবেই বেশ রাজনৈতিক মতাদর্শের অধিকারী ছিলেন ম্যারাডোনা। তিনি বারবারই বলেছেন, যতবার তিনি ফুটবলে পায়ের ছোঁয়া লাগান, আর্জেন্টিনার বস্তি থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চ- প্রতিটা চিত্র তিনি দেখতে পান চোখের সামনে। ফিফার দারিদ্র বিমুক্ত কর্মসূচীতেও নানা সময়ে দেখা গেছে ডিয়েগোকে।

ম্যারাডোনাকে আর্জেন্টিনাতে তুলনা দেওয়া হয় চে গুয়েভারার সঙ্গে, যার ট্যাটু ম্যারাডোনার বাহুতেই আছে,  ‘দুজন গ্রেট আর্জেন্টাইন একই শরীরে থাকা অবশ্যই বিরাট ব্যাপার’ বলেছেন ডিয়েগো।

১৯৯০ সালে আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট কার্লোস মিনেমের ছেলে যখন হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন, তখনও সবার আগে তাঁর কাছে ছুটে যান দিয়েগো ম্যারাডোনা ।

ম্যারাডোনা সবসময়ই আর্জেন্টাইন দারিদ্র নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। যারাই তার সাথে মিশেছে, তার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েছে, সবাই বলেছে, নিজের এত এত সম্পদ নিয়ে তিনি আক্ষেপ করতেন, কারণ তাঁর দেশের মানুষ যে ভাল নেই!

এভাবেই একজন ফুটবলার ‘নেতা’ না হয়েও হয়ে উঠেছেন জনমানুষের আদর্শ, আর্জেন্টাইন ক্ষুদে জাদুকর থেকে চে গুয়েভারাকে ধারণ করা ছোট্ট বিস্ফোরক!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link