রেকর্ড তৈরি হয় ভাঙার জন্য। নব্বই মিনিটের খেলায় প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙাগড়া হলেও কিছু রেকর্ড এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ফরাসী স্ট্রাইকার জাঁ ফন্তেইন মাত্র ছয় ম্যাচে ১৩ গোল করেছিলেন। এত বছর পরেও কেউ সেই রেকর্ড ভাঙা তো দূরে, ধারেকাছেও যেতে পারেননি।
ফন্তেইনের জন্ম ১৯৩৩ সালে মরক্কোর মারাকোশে। মরক্কো তখন ছিল ফ্রেঞ্চ উপনিবেশের অংশ। ছোটবেলাতে স্থানীয় ক্লাব মারাকোশের হয়ে খেলা শুরুর পর যোগ দেন ফুটবল ক্লাব কাসাব্ল্যাংকায়। তাদের হয়ে তিন বছর খেলার পর ফরাসি লিগের দলগুলোর নজরে আসেন। দুই পায়ে সমান দক্ষ, বলের উপর দারুণ নিয়ন্ত্রণ আর দুর্দান্ত গোলস্কোরিং ক্ষমতা সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন লোভনীয় এক স্ট্রাইকার।
প্রথমে নিসের হয়ে খেললেও পরে তাকে দলে ভেড়ায় তৎকালীন ফরাসি লিগের সবচেয়ে বড় দল রেঁইমস। মূলত তাদের কিংবদন্তি ফুটবলার রেমন্ড কোপার বিকল্প হিসেবেই ফন্টেইনকে দলে ভেড়ায় তারা। এই ক্লাবের হয়েই ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি।
ক্লাব ফুটবলে ক্যারিয়ারটা মসৃণভাবে এগোলেও জাতীয় দলে সহজেই সুযোগ পাননি ফন্টেইন। অথচ জাতীয় দলে অভিষেক ম্যাচেই লুক্সেমবার্গের বিপক্ষে করেছিলেন হ্যাটট্রিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরের তিন বছরে একবারও জাতীয় দলে ডাক পাননি।
১৯৫৮ বিশ্বকাপেও তার দলে ডাক পাওয়া নিশ্চিত ছিল না তার, কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচে রেনে ব্লিয়ার্ড ইনজুরিতে পড়লে কপাল খুলে যায় ফন্টেইনের। ফন্টেইন তখন ছিলেন ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে, ২৬ ম্যাচে ৩৪ গোল করে রেঁইমসকে সদ্যই জিতিয়েছেন ফরাসি লিগের শিরোপা। তাছাড়া গোটা শীতকালটা ইনজুরিতে পড়ে কাটিয়েছেন বিশ্রামে, যা কিনা তার জন্য পরে শাপেবর হয়েছিল।
বিশ্বকাপে রেমন্ড কোপার সাথে দারুণ এক জুটি গড়ে তোলেন ফন্টেইন। প্রথম ম্যাচেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে হ্যাটট্রিক করেন তিনি, তখনকার শক্তিশালী দল প্যারাগুয়েকে ফ্রান্স হারায় ৭-৩ গোলে। অথচ ম্যাচের একটা সময় লাতিন আমেরিকার দেশটি এগিয়ে ছিল ৩-২ গোলে। কিন্তু এক ফন্টেইন ঝড়েই উড়ে গিয়েছিল দলটি। পরের ম্যাচে যুগোস্লাভিয়ার কাছে ৩-২ গোলে হারলেও ফন্টেইন করেন জোড়া গোল।
গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নিজে এক গোল করার পাশাপাশি কোপাকে দিয়ে করান আরেকটি। ফ্রান্সও জয় পায় ২-১ গোলে। ফন্টেইনের গোলের ধারা অব্যাহত ছিল নক আউট পর্বেও, কোয়ার্টার ফাইনালে নর্দান আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। সেমিতে ফ্রান্স মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিলের। সেই বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলটি ছিল তর্ক সাপেক্ষে ইতিহাসের সেরা দল।
পেলে, গারিঞ্চা, দিদি, ভাভা, নিলটন সান্তোস, মারিও জাগালোদের নিয়ে ব্রাজিল দলটি ছিল টুর্নামেন্ট সবচেয়ে বড় ফেবারিট। ম্যাচের শুরুতে ভাভার গোলের ব্রাজিল এগিয়ে গেলেও মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সমতা ফেরান ফন্টেইন। কিন্তু ফ্রান্স ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় ৩৬ মিনিটে ফ্রান্স অধিনায়ক রবার্ট জংকে পা ভেঙে মাঠের বাইরে চলে গেলে।
তখনকার সময়ে খেলোয়াড় পরিবর্তনের নিয়ম না থাকায় দশজন নিয়েই খেলতে হয় তাদের। দশজন নিয়ে আর পরাক্রমশালী ব্রাজিলের সাথে পেরে ওঠেনি ফন্টেইনের ফ্রান্স। শেষ ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হওয়ার আগে ফন্টেইন গোলসংখ্যা ছিল ৯। আগের বিশ্বকাপেই স্যান্ডর ককসিসের করা ১১ গোলের রেকর্ড ভাঙতে হ্যাটট্রিক করার প্রয়োজন ছিল।
ফন্টেইন সেই ম্যাচে করেন চার গোল, ৬-৩ গোলে সেই ম্যাচ জিতে তৃতীয় হয় ফ্রান্স। ছয় ম্যাচে ১৩ গোল করে বিশ্বকাপ শেষ করেন তিনি। অথচ গোলসংখ্যা আরো বাড়তে পারত। তার একটি শট বারে লেগে ফিরে আসার পাশাপাশি একটি পেনাল্টি তিনি নিতে দেন সতীর্থ রেমন্ড কোপাকে। মজার ব্যাপার হল, পুরো বিশ্বকাপ তিনি খেলেছিলেন অন্যের বুট পরে!
বিশ্বকাপে দারুণ খেললেও ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি তিনি। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০, মাত্র দুই বছরের মধ্যে দুবার পা ভাঙলে তিনি মাত্র ২৮ বছর বয়সে বাধ্য হন ফুটবল থেকে অবসর নিতে। কমপক্ষে ৩০ গোল করা ফুটবলাদের মধ্যে তার ম্যাচ প্রতি ১.৪৩ গোলের রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। খেলা ছাড়লেও ফুটবল ছাড়তে পারেননি। অবসরের পর কোচিং করিয়েছেন মরক্কো, ফ্রান্স, পিএসজির মতো দলকে।
ক্রিকেটের স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ গড়ের মতোই ফন্টেইনের এক বিশ্বকাপে ১৩ গোল ফুটবল ইতিহাসে রয়ে যাবে অবিনশ্বর এক কীর্তি হিসেবে।