‘কেএমসি’ – রিয়াল মাদ্রিদের তিন মিডফিল্ডার ক্রুস, মদ্রিচ আর ক্যাসেমিরোদের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে এই নাম তৈরি হয়েছে। ইউরোপীয় ফুটবলের টুকটাক খোঁজ রাখে এমন কাউকে আসলে কেএমসির গুরুত্ব বোঝানোর প্রয়োজন হয় না। তিন দেশের তিন মিডফিল্ডার একত্রে রিয়ালকে কতশত উদযাপনের মুহূর্ত এনে দিয়েছে সেটাও গুণে শেষ করা যাবে না।
টনি ক্রুস, লুকা মদ্রিচ এবং কার্লোস ক্যাসেমিরো একসাথে যতগুলো ফাইনাল ম্যাচে মাঠে নেমেছে তার কোনটিতেই হারতে হয়নি লস ব্ল্যাঙ্কোসদের। এই একটা রেকর্ডেই আসলে উপলব্ধি করা যায় কতটা অপ্রতিরোধ্য এই ত্রয়ী।
জার্মান ফুটবল থেকে ইতোমধ্যে অবসর নেয়া টনি ক্রুস ফুটবলকে বিদায় বলার ক্ষণ গণনা করছেন। অন্যদিকে লুকা মদ্রিচের বয়সও অনেক আগে পেরিয়ে গিয়েছে ৩৫ এর কোটা। তাই ভক্ত-সমর্থকদের ধারণা ছিল হয়তো এই দুইজনের যে কারো অবসরের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে ‘কেএমসি’ অধ্যায়ের।
কিন্তু গোল বলের খেলা ফুটবলে কি হবে সেটা ধারণা করা মুশকিল। তেমনি খেলার বাইরের খেলায় কি হবে সেটাও বলা যায় না। এজন্যই ক্রুস কিংবা মদ্রিচ নয়; কেএমসির গল্প শেষ করতে যাচ্ছেন কার্লোস ক্যাসেমিরো। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হুট করে বুটজোড়া তুলে রাখছে নাকি!
কিন্তু আসলে অবসর নয়, বরং গুঞ্জন উঠেছে ক্লাব ছাড়তে যাচ্ছেন ক্যাসেমিরো। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এই ব্রাজিলিয়ানকে নিতে আগ্রহী। তিনি নিজেও দলটির প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে দেখছেন। ঐতিহ্যগত ভাবে যেমন-ই হোক, সাম্প্রতিক সময়ে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড রীতিমতো ধ্বংসস্তুপ।
সর্বজয়ী অল হোয়াইটদের ছেড়ে, এতদিনের সঙ্গী মদ্রিচ, ক্রুসদের ছেড়ে ভঙ্গুর রেড ডেভিল শিবিরে যোগ দিতে পারেন কার্লোস ক্যাসেমিরো- এমন তথ্য স্বাভাবিকভাবেই হতভম্ব করেছে সমর্থকদের। শুরুতে ইউনাইটেডের আগ্রহের কথা প্রকাশ হওয়ার পরে মাদ্রিদিস্তারা হয়তো একপ্রস্ত হাসাহাসি করেছিল কিন্তু সময় গড়াতেই দেখা যায় ক্যাসেমিরো নিজেও কিছুটা পরিবর্তন চাচ্ছেন ক্যারিয়ারে।
পাঁচ বছরের চুক্তি, দ্বিগুন বেতন, স্পোর্টিং প্রজেক্টের অন্যতম ভিত্তি – ত্রিশ বছরের একজন ফুটবলারের জন্য বড্ড লোভনীয় ব্যাপার। ক্যাসেমিরো নিজেও সেটা জানেন। তাই হয়তো পরিবার আর নিজের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভেবে ইউনাইটেডের সাথে আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন।
রিয়াল মাদ্রিদের সাথে এখনো তিন বছরের চুক্তি বাকি আছে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডারের। এই তিন বছরের তিনি মোট বেতন পাবেন ৩০ মিলিয়ন ইউরো। অন্যদিকে রেড ডেভিলদের প্রস্তাবে সাড়া দিলে পাঁচ বছরে পারিশ্রমিক মিলবে ১০০ মিলিয়ন ইউরো। পার্থক্যটা একটু বেশিই চোখে পড়ে।
আবার চলতি চুক্তি শেষ হলে স্প্যানিশ জায়ান্টরা ক্যাসেমিরোর কন্ট্রাক্ট রিনিউ করবে এমন সম্ভাবনা কম-ই। সেসময় তাঁর বয়স হয়ে যাবে ৩৩ বছর। এই বয়সে তখন চাহিদামাফিক পারিশ্রমিকে ভাল ক্লাব খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সবমিলিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের লাল জার্সি গায়ে জড়ানোর পক্ষে অনেক যুক্তি আছে ক্যাসেমিরোর জন্য।
সবচেয়ে বড় কথা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সম্ভাব্য সব ট্রফি জিতে নেয়া ক্যাসেমিরো নতুন কিছুর স্বাদ পাওয়ার জন্য ইংল্যান্ডে গেলেও বলার কিছু থাকবে না।
তবে লোভনীয় প্রস্তাবের বিপরীতে ক্যাসেমিরোর জন্য আছে শুধুই একটা সাদা শার্ট। রিয়াল মাদ্রিদের এই জার্সিতে মিশে আছে ভালবাসা, আবেগ। যদি কার্লোস ক্যাসেমিরো ইউনাইটেডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে থেকে যান, তবে সেটা শুধু মাত্র সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ের মায়ায়।
ক্যাসেমিরো স্পেনে থেকে গেলে তো রিয়ালের জন্য ভাল, কিন্তু যদি তিনি চলে যান? আসলে এই দলটা কখনোই একজন নির্দিষ্ট ফুটবলারের উপর নির্ভরশীল নয়। তাই অনেকদিনের ভরসা এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার চলে গেলে শুরুতে হয়তো সমস্যা হবে, তবে শীঘ্রই সেটা কাটিয়ে উঠতে পারবে লা লিগার বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা।
অন্যদিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মিডফিল্ড রিয়াল মাদ্রিদের তুলনায় নস্যি। ফ্রেড, ম্যাকটমিন্যায়ের মত গড়পরতা ফুটবলারের উপর নির্ভর করছে ইউনাইটেড।
তাই ক্রুস, মদ্রিচদের মত বিশ্বসেরাদের ছেড়ে এমন কারো সাথে খেলাটাই ক্যাসেমিরোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া নতুন শহর, নতুন পরিবেশ সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ারও একটা ব্যাপার আছে। বিশ্বকাপের আগে এই তারকা ফুটবলার নিজের ক্যারিয়ারে এমন পরিবর্তন আনবেন কি না সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
যতই সময় এগুচ্ছে ততই ক্যাসেমিরোকে রেড ডেভিল দুর্গে দেখার সম্ভাবনা বাড়ছে। রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ক্যাসেমিরো ঐক্যমতে পৌঁছালে হয়তো লাল জার্সি পরেই খেলা শুরু করবেন এই ব্রাজিলিয়ান। আবার আরো একটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কিংবা লা লিগা জেতার জন্য তিনি বার্নাব্যুতেও থেকে যেতে পারেন।
সর্বশেষ কয়েক বছরে ইকার ক্যাসিয়াস, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, সার্জিও রামোস, রাফায়েল ভারানে, মার্সেলো, বেলদের মত আইকনিক কয়েকজন খেলোয়াড় রিয়ালকে ‘গুড বাই’ বলেছিলেন। সেসব ক্ষত এখনো যায়নি মাদ্রিদিস্তাদের মন থেকে। এবার ক্যাসেমিরোর অপ্রত্যাশিত বিদায়ের গুঞ্জন পুরোনো ক্ষতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ক্যাসেমিরোর গন্তব্য কোথায়; ইংল্যান্ড নাকি স্পেন কোথায় দেখা যাবে তাকে – উত্তর জানতে অল্প কিছু সময় বাকি। তবে যদি পরিচয় পরিবর্তন করেন এই ফুটবলার, তবে সেটা কেমন প্রভাব রাখবে তাঁর ক্যারিয়ারে সেটা জানার জন্য কয়েকটা মাস অপেক্ষায় থাকতে হবে।