কলকাতা ফুটবল নিয়ে এমনিতে আর লিখতে ইচ্ছে না ফেসবুকে অধিকাংশ ক্লাব সমর্থকের বিশ্রী ভাষা দেখে। তবু কাকতালীয় ভাবে, বড় ম্যাচের পরদিনই একটা লেখা তৈরি হয়ে গেল আনন্দবাজারে আমার প্রাক্তন সহকর্মী সুব্রতর প্রশ্নের সৌজন্যে।
কেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের ‘লোটা’ বলা হয়, কেন মোহনবাগান সমর্থকদের ‘মাচা’?
গোটা কুড়ি ফোন ঘোরানোর পরেও এই প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর পেলাম না। যা পেলাম, চূড়ান্ত ভাসা ভাসা। অনেকে পুরোপুরি হাত তুলে দিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, এক একটা ব্যাখ্যা এক এক রকম। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট — এক পক্ষ আর এক পক্ষকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেই ডাকে এ নামে। বিদ্রুপ থেকেই এর সৃষ্টি।
কোনও সন্দেহই নেই, ফেসবুকের দৌলতেই গত সাত আট বছর ধরে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের ভাষায় এ দুটো শব্দ এসেছে। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের আগে এ সব শোনা যেত না। তখন শোনা যেত, ‘ছারপোকা’ এবং ‘জার্মান’। দুটো দলের সমর্থকরা বিপক্ষকে এই নামে ব্যঙ্গে ভরিয়ে দিত। এখন ‘মাচা’, ‘লোটার’ দৌলতে কলকাতা ফুটবলের আকাশ থেকে সরে গিয়েছে ‘ছারপোকা’ ও ‘জার্মান’। হয়তো পরের শতকে দুটো টিম টিকে থাকলে উঠে আসবে অন্য কোনও শব্দ।
কেন ছারপোকা, কেন জার্মান? এর উত্তরেও বিভ্রান্তি ঘিরে ধরে। আমাদের পূর্বসূরি এবং সমসাময়িক অনেক বিশিষ্ট সাংবাদিক ও পরিচিত কর্তা-সমর্থকদের দ্বারস্থ হই। তাঁদেরও এক একজনের এক এক এক ব্যাখ্যা। দেখে আশ্বস্ত হই, আমার মতো অনেকেরই এক দশা। যা বুঝলাম, তাতে এখনকার মতো তখনও অনেক লোকে এ সব মানে না জেনেই বলে বেড়াত। কে প্রথম চালু করেছে এ সব, কেউ জানত না। বিপক্ষকে গালমন্দ করেই তৃপ্তি। আজও কোনও অধ্যাপক বা আইটি কর্মী বা গায়ক ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে মাঠে গেলে গলগল করে গালাগাল দিতে থাকেন। যেন ওই লোকটা সেই লোকটা নয়। ভিতরের যত রাগ, ঢালো সেখানে। এখন তাঁদের অনেকের কাছে মাঠটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক। খুব কম লোকের ব্যঙ্গেই মিশে থাকে আভিজাত্য।
কেন ব্যঙ্গ করে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা ‘ছারপোকা’ বলতেন মোহনবাগানের সমর্থকদের? আমার নিজের কোনও ব্যাখ্যা নেই। যা পেলাম, পরপর লিখে দিলাম।
১. ছারপোকা যেমন প্রথমে আক্রমণ করে, কিন্তু সহজেই টিপে ফেলে মেরে ফেলা যায়।
২. ছারপোকা প্রচুর তড়পায়, আসলে কোনও ক্ষমতাই নেই।
৩. ছারপোকার সঙ্গে বাবুয়ানির মেলে টিপ্পনিতে। আসলে টিপ্পনিগুলো খুব অল্প সময়ের। কোনও মূল্য নেই। দ্রুত হারিয়ে যায়।
কেন ব্যঙ্গ করে মোহনবাগান সমর্থকরা ‘জার্মান’ বলতেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের? এখানেও আমার নিজের কোনও ব্যাখ্যা নেই। যা পেলাম, পরপর লিখে দিলাম।
১. ওপার বাংলা থেকে যখন এ পার বাংলায় মানুষ এলেন, তাঁদের ভাষা একেবারে অবোধ্য লাগত কলকাতা, হাওড়া, হুগলির মানুষদের। কিছুই বুঝতে পারত না। তখন ইংরেজ রাজত্ব। ইংরেজদের বিপক্ষ জার্মান। তাই জার্মানদের মতো ভাষা বানিয়ে দাও। উদ্ভট মানেই তো জার্মান।
২. জার্মানি যেমন ভাগ হয়ে গিয়েছিল, তেমন ভারত ভাগের সময় পূর্ব বাংলা গিয়েছিল অন্য দেশে। তাই জার্মান শব্দটা চলে আসে ইস্টবেঙ্গলকে বোঝাতে।
৩. হিটলারের জার্মানরা উদগ্র, কাউকে মানে না। অন্যের জায়গা জোর করে দখল নেয়। সব সময় ‘মাইরা ফালুম, কাইট্যা ফালুম’ চিৎকার। দাও ইস্টবেঙ্গলের উদ্বাস্তুদের সঙ্গে জার্মান মিলিয়ে। কলোনীতে জোর করে জায়গা নেওয়া চলে। ইস্টবেঙ্গলের জার্সির রংয়ের সঙ্গে জার্মান জার্সির আবার মিল।
৪. এই ব্যাখ্যাটা আবার ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরাই করেন। জার্মানদের মতো তাঁরাও অদম্য। পিছিয়ে পড়ে হাল ছাড়েন না। জিতবই মনোভাব। কিন্তু মনে হয় না, এখান থেকে ব্যাপারটা তৈরি। কেননা তা হলে তো ‘ছারপোকা’ ও ‘জার্মান’ দুটোই লাল হলুদ সমর্থকদের তৈরি হয়ে যায়। বরং এটা সম্ভব, ‘জার্মান’ শুনতে শুনতে কোনও কোনও ইস্টবেঙ্গল সমর্থক পাল্টা এই তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন।
বড় ক্লাবের কর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সী হলেন অজয় শ্রীমানী। ছিয়াশি চলছে। ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগের আমলের ফুটবল সচিব। কথা বলে দেখলাম, তাঁর বিশ্বাস, ‘ছারপোকা’ এবং ‘জার্মান’ শব্দ দুটোই তৈরি ইস্টবেঙ্গলেরও কারও। ‘জার্মান’ বিদ্রুপাত্মক শব্দ হিসেবে নয়, গৌরবাত্মক অর্থে তৈরি। কিন্তু বাস্তব বলছে, এটা সম্ভব নয়। কেন তা হলে মোহনবাগান সমর্থকরা ওই শব্দ ব্যবহার করতে যাবেন? ইলিশ এবং চিংড়ি যে ভাবে প্রতীক হয়ে গিয়েছে দুটো টিমের, সেটাও যে কী করে, এই প্রশ্নটা অমীমাংসিত থেকে গিয়েছে। অজয়বাবুর স্মৃতি আজও অসাধারণ। তিনিও বাড়তি আলো ফেলতে পারেননি ইলিশ-চিংড়ি বা ছারপোকা-জার্মানির উপর।
এ বার প্রশ্ন হচ্ছে, মাচা এবং লোটা শব্দের মানেটা কী? এখানেও নানা তত্ত্ব শুনলাম। কোনও সন্দেহ নেই, দুটো শব্দ এই প্রজন্মের তৈরি। বিশিষ্ট অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা অধিকাংশ এই দুটো শব্দ শোনেনইনি। ফোনে শুনলেন। এবং এখানে আরও বিভ্রান্তি রয়েছে উৎসের পিছনে। ‘লোটা’ শব্দটার উৎস তবু কিছুটা স্পষ্ট। ‘মাচা’ শব্দ নিয়ে অনেক বেশি ব্যাখ্যা।
ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কেন ‘লোটা’ বলে মোহনবাগান? এখানেও আমার নিজের কোনও ব্যাখ্যা নেই। যা পেলাম, পরপর লিখে দিলাম।
১. পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আসার সময় লোটা কম্বল ছাড়া কিছু ছিল না ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের। সেখান থেকে বড়লোক হয়েছে। আঙুল ফুলে কলাগাছ।
২. লোটা নিয়ে প্রাত:কৃত্য করার অভ্যাস অনেকের। সব কিছু নোংরা করার প্রবণতা। শরণার্থী শিবিরে এমন নোংরা জিনিস দেখা যেত পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসার সময় শিবিরে, শিবিরে।
৩. মোহনবাগান সমর্থকদের ‘ঘটি’ বলে বিদ্রুপ করা হতো। ঘটির পাল্টা হিসেবে ‘লোটা’ চালু হয়। ঘটিতে যেমন আভিজাত্য রয়েছে, লোটাতে তেমনই রয়েছে অসংস্কৃতির ছাপ।
কেন মোহনবাগান সমর্থকদের ‘মাচা’ বলে ইস্টবেঙ্গলের? আমার নিজের কোনও ব্যাখ্যা নেই। যা পেলাম, পরপর লিখে দিলাম।
১. উত্তর কলকাতায় রকে আড্ডা হতো আগে। এখন রকের বদলে পাড়ায় আড্ডা হয় মাচা বেঁধে। ওদের শুধু আড্ডা কোনও কাজ নেই। আড্ডা আর বাবুয়ানি।
২. ডরফুক। বড় বড় কথা বলে। কিন্তু তাড়া করলে বাড়ির একেবারে উপরে মাচায় উঠে যায়।
৩. মোহনবাগানের প্রতীক নৌকো। নৌকোয় মাচা থাকে। সেখানে শুধু ভুলভাল কাজ হয়। অকাজ, কুকাজ।
৪. প্রথমে মোহনবাগানের লোগো ছিল বাঘ। পরে বাঘ পালটে পালতোলা নৌকা করা হয়। ইস্টবেঙ্গল পরিচিত হয় রয়্যাল বেঙ্গল হিসেবে। অনেক বাঘ শিকারী যেমন ভয় পেয়ে মাচায় উঠে যায়, তেমন মোহনবাগান সমর্থকরাও তেমন। মাচার সঙ্গে তুলনা করা যায়।
দুটো শব্দের মানে খুঁজতেই হিমসিম। অকারণ উৎস খুঁজতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। দুটো শব্দের ‘জন্মদাতা’ সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই বলে এখানে যে কেউ আরও কিছু ব্যাখ্যা যোগ করে দিতে পারেন স্বচ্ছন্দে। কেননা ফেসবুকে যাঁরা ‘মাচা’, ‘লোটা’ নিয়ে খিল্লির ঝড় তোলেন, তাঁদের অনেককে প্রশ্ন করে উত্তর পেলাম, ‘ঠিক জানি না, দাদা। কী বলতে কী বলে দেব। বলি, বলতে ভালোবাসি তাই।’
আমিও ঠিক জানি না, দাদা। কী লিখতে কী লিখে বসলাম। লিখলাম, লিখতে ভালোবাসি তাই।