‘For wholesome mastery, there’s Tendulkar; for wizardry there’s Warne; for technical virtuosity there’s Dravid; and to bat for your life, there’s Steve Waugh. But for light and song, for bliss and glory and for lifting the soul, who else but Brian Lara?’ – লারা সম্পর্কে কথাগুলো বলেছিলেন প্রয়াত ধারাভাষ্যকার, লেখক ও ক্রীড়া বিশ্লেষক টনি কোজিয়ার।
সহজাত স্ট্রোক মেকার লারার ব্যাটিং মানেই ছিল নান্দনিকতা। ক্লাস, স্টাইল, গ্রেস কী ছিল না তাঁর! হাই ব্যাকলিফট, রিদমিক ব্যাট সুইং! রাজসিক ড্রাইভ, কাট, পুল! যখন ব্যাটিং করতেন, মনে হত কোনো শিল্পী তুলির আঁচড় দিচ্ছেন সবুজ ক্যানভাসে! মুগ্ধতার রেশ যেন কাটতে চাইত না কিছুতেই। বাইশ গজে লারার উপস্থিতি মানেই ছিল প্রাণের স্পন্দন, নির্মল ক্রিকেটীয় বিনোদনের শতভাগ নিশ্চয়তা।
উইজডেনের সাবেক সহসম্পাদক চার্লি অস্টিনের ভাষায়, ‘Lara at his best restores cricket as a game of sublime skills and high art.’ ‘ক্রিকেটের বরপুত্র’ কিংবা ‘প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ’ খ্যাত বাঁ-হাতি ব্যাটিং জিনিয়াসের সেরা পাঁচটি ইনিংস নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন।
- ২৭৭, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, সিডনি, ১৯৯৩
ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। নিঃসন্দেহে স্পেশাল ইনিংস। লারার বয়স তখন মাত্র ২৩। এই ইনিংসটি নিয়ে বলার আগে কিছু পরিসংখ্যান জানিয়ে রাখা ভাল। লারার ২৭৭ রানের ইনিংসটি অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক টেস্ট সিরিজের ইতিহাসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস, যে রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারে নি।
মেলবোর্ন টেস্টে লজ্জাজনক হারের পর সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে লারার যখন ডেব্যু হল, দলের সবার আত্মবিশ্বাস তখন তলানিতে। তাছাড়া সিডনিতে খেলা আগের ১১টি টেস্টের ৮টিতেই পরাজিত দলের নাম ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জর্জ হেডলির কল্যাণে সিডনিতে সবশেষ জয়টি এসেছিল ৬২ বছর আগে!
সিডনি টেস্টের উইকেট ছিল যাকে বলে ‘ব্যাটিং প্যারাডাইস’। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ৫০৩ রান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৩১ রান তুলতেই সফরকারীদের নেই ২ উইকেট। অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসনকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে এলেন ব্রায়ান লারা। এসেই শুরু করলেন আক্রমণ।
প্রায় আড়াই দিন ফিল্ডিং করার ধকল সহ্য করার পরও লারাকে দেখাচ্ছিল চনমনে, প্রাণবন্ত। যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন, বোলারদের ওপর দিয়ে রীতিমতো স্টিম রোলার চালিয়েছিলেন লারা। বৃষ্টি ও আলোকস্বল্পতার কারণে বারবার খেলায় বিঘ্ন সৃষ্টি হলেও লারার ব্যাটিংয়ে ছন্দপতন হয়নি একবারের জন্যও। চতুর্থ দিন শেষ বিকেলে কার্ল হুপারের সাথে ভুল বোঝাবুঝিতে লারা যখন রান আউট হয়ে ফিরছেন, নামের পাশে লেখা ৩৭২ বলে ২৭৭ রান।
পরিসংখ্যান অনেক সময়ই একটা দুর্দান্ত স্পেল বা ইনিংসের গ্রেটনেস বোঝাতে পারে না। তবুও বলছি, লারার ইনিংসের স্ট্রাইক রেট ছিল ৭৪.৬৪! বাউন্ডারি মেরেছিলেন ৩৮টা যা তাঁর মোট রানের ৫৪ শতাংশ। লারার ডমিনেশন বোঝাতে ম্যাচের চতুর্থ দিনের একটা স্ট্যাটস দিই। লারা একাই করেছিলেন ১৫৪ রান, বাকিরা মিলে মাত্র ৭৪ রান! লারা একাই মেরেছিলেন ২৩টা চার, অপর তিন সঙ্গী মিলে মাত্র ৫টা!
৩৭২ বলের ইনিংসে মাত্র একবার ‘আউট’ হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন লারা। মার্ভ হিউজের বলে ব্যক্তিগত ১৭২ রানের মাথায় পয়েন্টে ক্যাচটা রাখতে পারেন নি স্টিভ ওয়াহ।
লারার ২৭৭ সম্পর্কে অজি কাপ্তান অ্যালান বোর্ডার বলেছিলেন, ‘For sheer crisp hitting of the ball into the gaps, it was as good as you’d ever seen.’
ওয়েস্ট ইন্ডিজের তৎকালীন কোচ রোহান কানহাইয়ের মতে, ‘One of the greatest innings I’ve ever seen. Back foot, front foot, timing, placement, against spin bowlers and fast bowlers alike. He was marvellous.’
- ২১৩, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, কিংস্টন, ১৯৯৯
লারা তখন অফ ফর্মে। সবশেষ ২৭ ইনিংসে কোন সেঞ্চুরি নেই। এদিকে আগের ম্যাচেই অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়েছে তাঁকে। যে ম্যাচে নিজেদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন ৫১ রানে অলআউট হওয়ার লজ্জায় ডুবতে হয়েছে ক্যারিবীয়দের, হারতে হয়েছে ৩১২ রানের বিশাল ব্যবধানে। টানা ছয় টেস্ট হারের গ্লানি সহ্য করার মত ক্ষমতা লারার দলের আছে কিনা এ নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। অন্যদিকে জ্যামাইকার দর্শকরাও লারার ওপর ক্ষুদ্ধ, কেননা তাদেরই ‘ঘরের ছেলে’ ওয়ালশকে সরিয়ে লারাকে ক্যাপ্টেন করা হয়েছে।
একদিকে ক্যারিবীয় ক্রিকেটে ক্রাইসিসের অন্ত নেই, অন্যদিকে লারাকে সামলাতে হচ্ছিল নেতৃত্বের সীমাহীন চাপ। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ইতিহাসে আর কোন অধিনায়ককে এতটা চাপের মুখে পড়তে হয়েছে কিনা সন্দেহ। টসের সময় লারা নাকি স্টিভ ওয়াহকে বলেছিলেন, ‘আজ হয়ত জীবনে শেষবারের মত টস করতে নামছি।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং লাইনআপ তখন ঠিক কতটা ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল, সেটা বোঝানোর জন্য একটা তথ্য দিই। জ্যামাইকায় সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ২৫৬ রান। অথচ ধারাভাষ্যকাররা বলাবলি করছিল, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফলো-অন এড়াতে পারবে তো?’
ব্যাটিংয়ে নেমে যথারীতি ৩৭ রান তুলতেই নেই ৪ উইকেট! যাই হোক, ৩৭/৪ স্কোর নিয়েই প্রথম দিনের খেলা শেষ করে উইন্ডিজ, লারা অপরাজিত ছিলেন ৭ রানে।
পরের দিন সকালে আবার শুরু হল খেলা। এদিকে ৫৬ রানের মাথায় ম্যাকগ্রার বলে ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন পেদ্রো কলিন্স। ফলোঅন এড়াতে তখনও লাগে ১ রান!
যোগ্য সহচর হিসেবে লারা সেদিন পাশে পেলেন বাঁহাতি জিমি অ্যাডামসকে। দুজন মিলে শুরু করলেন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। সেদিন শুরুতে একটু দেখে শুনে সাবধানেই খেলছিলেন লারা; শট নির্বাচনের বেলাতেও ছিলেন বেশ সিলেক্টিভ। প্রথম ৫০ রান তুলতে বল খরচ করলেন ১৪০টা! তবে পঞ্চাশ পেরোনোর ঠিক পরপরই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন তিনি; যার শুরুটা করলেন শেন ওয়ার্নকে লং অনের ওপর দিয়ে সোজা গ্যালারিতে আছড়ে ফেলে। ব্যস! নিজের সহজাত স্ট্রোকপ্লে দিয়ে ক্রমেই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে আরম্ভ করলেন লারা।
একপ্রান্তে জিমি অ্যাডামসের অবিচল নিষ্ঠা ও সংযত প্রতিরোধ, আর অন্যপ্রান্তে কাউন্টার অ্যাটাকিং স্টাইলে খেলে বোলারদের রীতিমতো কচুকাটা করছিলেন লারা। দিনশেষে লারা মাঠ ছাড়লেন ২১২ রানে অপরাজিত থেকে; অ্যাডামসের নামের পাশে লেখা ৮৮ নট আউট। আর ৯০ ওভার বোলিং করে অস্ট্রেলিয়ার পুরো বোলিং ইউনিট ছিল উইকেটশূন্য!
দিনের হাইলাইটস ছিল ম্যাকগিলের বলে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ ছক্কা আর শেন ওয়ার্নের এক ওভারে টানা চার বলে বাউন্ডারি হাঁকানোর দৃশ্য।
লারা আউট হয়েছিলেন পরদিন সকালে, ৩২২ রানের ম্যারাথন জুটিটা ভেঙেছিলেন ম্যাকগ্রা। লারার ৩৪৪ বলে ২১৩ রানের ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ ইনিংসটাতে ছিল ২৯টি চার ও ৩টি ছক্কার মার। তবে দুর্ভাগ্য অ্যাডামসের; মাত্র ৬ রানের জন্য সেঞ্চুরি বঞ্চিত হন তিনি।
লারার ইনিংসটা সম্পর্কে টনি কোজিয়ারের বক্তব্য ছিল, ‘In its context, with due deliberations and apologies to George Headley, Sir Garry Sobers and a host of other greats, I cannot identify a single innings by any West Indian batsman in our 71 years of Test cricket of such significance.’
উইজডেন লিখেছিল, ‘Lara seduced the people of a bankrupt nation, resurrected his career as a batsman of rare gifts and reignited cricket throughout the Caribbean. It was, by universal consent one of the great Test innings.’
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৪৩১ রানের জবাবে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৭৭ রানে অলআউট হয় অস্ট্রেলিয়া। ১০ উইকেটের বিশাল জয়ে অবিশ্বাস্যভাবে সিরিজে কামব্যাক করে ক্যারিবীয়রা।
- ১৫৩*, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, বার্বাডোজ, ১৯৯৯
বার্বাডোজ টেস্টের প্রথম তিন দিন ডমিনেট করেছিল অস্ট্রেলিয়ানরাই। স্টিভ ওয়াহর অনবদ্য ১৯৯ রানে ভর করে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া তুলেছিল ৪৯০ রান। জবাব দিতে নেমে মাত্র ৯৮ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে উইন্ডিজ। শেরউইন ক্যাম্পবেল আর রিডলি জ্যাকবসের ১৫৩ রানের জুটিতে শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়ায় তারা। দ্বিতীয় ইনিংসে বোলারদের উজ্জীবিত পারফরম্যান্সে অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ১৪৬ রানে বেঁধে ফেললে চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য স্বাগতিকদের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩০৮ রান। ‘অসম্ভব’ না হলেও চতুর্থ ও পঞ্চম দিনের ব্যাটিং দুরূহ উইকেটের জন্য অত্যন্ত কঠিন একটা টার্গেট, যেখানে প্রতিপক্ষ দলে আছে ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি, ওয়ার্ন, ম্যাকগিলের মত চ্যাম্পিয়ন সব বোলার।
এমন কঠিন একটা সমীকরণকে সামনে রেখে ম্যাচের চতুর্থ দিন শেষ বিকেলে ব্যাটিংয়ে নামল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যাম্পবেল-গ্রিফিথের ৭২ রানের উদ্বোধনী জুটি শুভ সুচনা এনে দিলেও দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় তারা। অবশেষে ৮৫/৩ স্কোর নিয়ে দিন শেষ করে স্বাগতিকরা। লারা অপরাজিত থাকেন ২ রানে। জয়ের জন্য তখনও লাগে ২২৩; হাতে আছে ৭ উইকেট।
এদিকে পঞ্চম দিনের খেলা শুরু হতে না হতেই ফিরে যান আগের দিনের অপরাজিত ওপেনার আদ্রিয়ান গ্রিফিথ (৩৫) আর ছয়ে নামা কার্ল হুপার (৬)। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর তখন ১০৫/৫। সমর্থকরা অবশ্য তখনও ফাইটব্যাকের স্বপ্ন দেখছিলেন, কেননা ক্রিজে ছিলেন ব্রায়ান লারা! কিন্তু কেবল লারার একার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না, তাঁর একজন যোগ্য সঙ্গীরও প্রয়োজন ছিল। অবশেষে জিমি অ্যাডামসের মাঝেই সেই সঙ্গীর দেখা পেলেন লারা, যার ওপর ভরসা করা যায়।
১৬১/৫ স্কোর নিয়ে লাঞ্চে গেলেন দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান। লাঞ্চ থেকে ফিরেই রীতিমতো লাগামছাড়া হয়ে উঠলেন লারা। দুই ‘লেগ স্পিনার’ ওয়ার্ন আর ম্যাকগিলের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে লাগলেন। ওয়ার্নকে আছড়ে ফেললেন গ্যালারির ছাদে আর দুই ছক্কাসহ ম্যাকগিলের এক ওভারে নিলেন ১৪!
লারার আগ্রাসনের হাত থেকে সেদিন নিস্তার পান নি ম্যাকগ্রা-গিলেস্পিরাও। পুল, হুক, কাভার ড্রাইভ, স্কয়ার কাট, ব্যাকফুট পাঞ্চের মত মনোমুগ্ধকর সব শটে একটার পর একটা বলকে বাউন্ডারির বাইরে আছড়ে ফেলতে লাগলেন লারা। ম্যাকগ্রার বাউন্সার হেলমেটে লাগার পরেও দমে যান নি তিনি, পরের বলেই পুল করে চার মেরেছেন!
হাফ সেঞ্চুরিতে পৌঁছুতে লারা খরচ করেছিলেন ১১৮ বল, অথচ সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন মাত্র ১৬৯ বলে!
২৩৮ রানের মাথায় ম্যাকগ্রার বলে বোল্ড হয়ে বিদায় নিলেন জিমি অ্যাডামস। সপ্তম উইকেট জুটিতে আসা ১৩৩ রানের মধ্যে জিমির অবদান ছিল মাত্র ৩৮! এদিকে স্কোরবোর্ডে আর মাত্র ১০ রান যোগ হতেই পরপর দু’বলে ২ উইকেট তুলে নিয়ে খেলা জমিয়ে দিলেন ম্যাকগ্রা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর গিয়ে দাঁড়াল ২৪৮/৮!
ম্যাচে টেনশন-উত্তেজনা তখন চরমে। ‘দুই নবিশ’ অ্যাম্ব্রোস আর ওয়ালশকে নিয়ে লারা কি পারবেন দলকে জয়ের বন্দরে পোঁছে দিতে?
হ্যাঁ, লারা সেদিন পেরেছিলেন। নবম উইকেটে অ্যাম্ব্রোসকে নিয়ে গড়লেন ৫৪ রানের জুটি। লক্ষ্য থেকে মাত্র ৬ রান দূরে থাকতে অ্যাম্ব্রোস (১২) ফিরে গেলে আবারও দুর্দান্তভাবে খেলায় ফিরে আসে অস্ট্রেলিয়া। তবে ওয়ালশকে (০) নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর বেশেই মাঠ ছেড়েছিলেন লারা। গিলেস্পিকে কাভার ড্রাইভে মারা জয়সূচক বাউন্ডারিটাও এসেছিল লারার ব্যাট থেকেই।
১৯ চার ও ১ ছক্কায় সাজানো লারার ২৫৬ বলে ১৫৩* রানের ‘মহাকাব্যিক’ ইনিংসটা অনেকের মতেই তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেনের বিচারে যেটি টেস্ট ইতিহাসের সর্বকালের ‘দ্বিতীয় সেরা’ ইনিংস। প্রথম স্থান অধিকারী ইনিংসটি স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ২৭০, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৩৭ সালের অ্যাশেজে।
লারার দুর্ধর্ষ ইনিংসটি নিয়ে জনপ্রিয় ক্রীড়ালেখক পিটার রোবাক একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘Throughout this epic performance Lara knew he could not afford to make a single mistake. Throughout, the Australians fought for his wicket like mongrels over a bone but Lara refused to oblige. Instead he constructed a masterpiece of batting that turned impending defeat into sudden and unexpected victory.’
- ২২১ ও ১৩০, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, কলম্বো, ২০০১
একটা সময় ছিল, যখন শ্রীলঙ্কা সফররত যেকোন দলের গেমপ্ল্যানের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকতেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। মুরালিকে সামলানোর উপায় খুঁজে বের করা মানে জয়ের পথে দুই-তৃতীয়াংশ এগিয়ে যাওয়া। বিশ্বসেরা এই অফ স্পিনারের ঘূর্ণি রহস্য ভেদ করতে গিয়ে হিমশিম খান নি, পৃথিবীতে এমন ব্যাটসম্যান বোধ হয় চাইলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
২০০১ সালের লঙ্কা সিরিজে মুরালির বিপক্ষে প্রতি-আক্রমণের কৌশল বেছে নিয়েছিলেন লারা। পুরো সিরিজ জুড়ে তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই; তা হল মুরালিকে ডমিনেট করা। সে লক্ষ্য থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হন নি তিনি। এ ছিল ধ্রুপদী এক লড়াই; গ্রেট ব্যাটসম্যান ভার্সেস গ্রেট বোলার।
সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচটা হয়েছিল কলম্বোতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে করা ৩৯০ রানের ভেতর লারার একার ব্যাটেই এসেছিল ২২১ রান। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসেও খেলেন ১৩০ রানের দুঃসাহসী ইনিংস, ওয়েস্ট ইন্ডিজের দলীয় স্কোর যেখানে ২৬২। টার্নিং উইকেটে বিশ্বসেরা স্পিন আক্রমণের বিপক্ষে ‘মাস্টারক্লাস’ লেভেলের দুটো নক।
অথচ এরপরেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটা হেরেছিল ১০ উইকেটের ব্যবধানে। টেস্ট ইতিহাসে পরাজিত দলের পক্ষে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ রানের (৩৫১) রেকর্ডটাও নিজের করে নেন লারা।
লারার সতীর্থদের কাছে মুরালি যতটা দুর্বোধ্য ছিলেন, লারার সামনে মনে হচ্ছিল ঠিক ততটাই সহজবোধ্য। মুরালির প্রতিটি ভ্যারিয়েশনের রহস্য ভেদ করতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। বিগ টার্নিং অফ ব্রেক, দুসরা, টপ স্পিনার সব! মুরালির বিপক্ষে তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল টগবগে; ফুট মুভমেন্ট ছিল কুইক এবং ডিসাইসিভ। মুরালিকে ‘ডাউন দ্য উইকেটে’ এসে লং অন, লং অফের ওপর দিয়ে উড়িয়ে মারার বেলায় তিনি যেমন দুঃসাহস দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনই স্বাচ্ছন্দ্য দেখিয়েছেন কাট, সুইপ এবং ড্রাইভ খেলার বেলাতেও।
ম্যাচ বাঁচাতে না পারলেও লারার একার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব তিনি করেছেন। একপ্রান্ত থেকে অসহায়ের মত তাঁকে দেখতে হয়েছে সতীর্থদের যাওয়া আসার মিছিল। মুরালির সামনে টেলএন্ডার তো বটেই, এমনকি টপ অর্ডারও যাতে এক্সপোজড না হয় সেজন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন লারা। যখন প্রয়োজন স্ট্রাইক ধরে রেখে খেলেছেন, দ্রুত রান তোলার সব দায়িত্ব একা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
লারার তান্ডবে দুই ইনিংসে মুরালির ফিগারটাও ছিল দেখার মত! প্রথম ইনিংসে ৩৭-৬-১১৫-১! এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৬-৫-১১৬-২! প্রতিটি উইকেটের জন্য মুরালিকে খরচ করতে হয়েছিল ৭৭ রান এবং ১১০ বল!
মুরালিকে উইকেট নেওয়া থেকে বঞ্চিত করতে পারলেও চামিন্দা ভাসের বিষাক্ত সুইংয়ের হাত থেকে দলকে বাঁচাতে পারেন নি লারা। দুই ইনিংস মিলিয়ে একাই ১৪ উইকেট নিয়ে মূল সর্বনাশটা করেছিলেন ভাসই।
- ৩৭৫, বিপক্ষ ইংল্যান্ড, অ্যান্টিগা, ১৯৯৪
লারার ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি। এই ইনিংসটাকে আমার কাছে কিছুটা ‘আন্ডাররেটেড’ মনে হয়। লারার ১৫৩, ২১৩ এমনকি ৪০০ নিয়েও যতটা আলোচনা হয়, ৩৭৫ নিয়ে ততটা হয় না। হ্যাঁ, আমি মানছি যে পিচ ফ্লাট ছিল, ম্যাচটাও ড্র হয়েছিল, লারার ‘ট্রিপল’ বাদে ম্যাচে মনে রাখার মত কিছু ছিলও না, ইংল্যান্ডের তখনকার বোলিং আক্রমণও তেমন আহামরি ছিল না; কিন্তু তারপরেও লারার ইনিংসটার মাহাত্ম্য তাতে কমে যায় না এতটুকুও।
১৯৯৪ সালের ১৬ এপ্রিল, অ্যান্টিগায় সিরিজের পঞ্চম ও শেষ টেস্টে মুখোমুখি ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম চার টেস্টের তিনটিতেই জিতে ইতিমধ্যেই ‘উইজডেন ট্রফি’টা নিশ্চিত করে ফেলেছে স্বাগতিকরা।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং নিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। লারা নেমেছিলেন ওয়ান ডাউনে। মাত্র ১২ রানে দুই ওপেনারকে হারালেও জিমি অ্যাডামসকে সাথে নিয়ে ৩য় উইকেট জুটিতে লারা গড়ে তোলেন শক্ত প্রতিরোধ। দলীয় ১৯১ রানের মাথায় অ্যাঙ্গাস ফ্রেজারের বলে অ্যাডামস (৫৯) ফিরে গেলেও কিথ আর্থারটনকে নিয়ে দিনের বাকি সময়টুকু নিরাপদেই পার করেন তিনি। দিনশেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর দাঁড়ায় ২৭৪/৩, লারার নামের পাশে লেখা অপরাজিত ১৬৪*।
১৭ এপ্রিল, ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে উইকেট পড়েছিল মাত্র একটা। কিথ আর্থারটনকে (৪৮) আউট করে ১৮৩ রানের জুটি ভেঙেছিলেন অ্যান্ডি ক্যাডিক। লারা-চন্দরপলের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে দিনশেষে ক্যারিবিয়ানদের সংগ্রহ ৫০২/৪, লারা অপরাজিত ৩২০* রানে।
১৮ই এপ্রিল, ১৯৯৪। এদিন কান পাতলেই অ্যান্টিগার আকাশে-বাতাসে শোনা যাচ্ছিল রেকর্ড ভাঙার গুঞ্জন। কিংবদন্তি অলরাউন্ডার স্যার গ্যারি সোবার্সের ৩৬ বছরের পুরনো রেকর্ড (৩৬৫ রান) ভাঙার হাতছানি লারার সামনে। লারা কি পারবেন টেস্ট ইতিহাসের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডটি নিজের করে নিতে?
গ্রাহাম গুচ (৩৩৩), স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (৩৩৪), ওয়ালি হ্যামন্ড (৩৩৬), হানিফ মোহাম্মদ (৩৩৭) এঁদের সকলকে পেছনে ফেলতে একদমই সময় নেন নি লারা। এভাবেই একসময় স্যার লিওনার্ড হাটনের ৩৬৪ এবং স্যার গ্যারি সোবার্সের ৩৬৫-কেও দূরে ঠেলে দিয়ে লারা উঠে গেলেন শীর্ষে, সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সোবার্সের ৩৬ বছরের পুরনো রেকর্ডটা ভেঙেছিলেন ক্রিস লুইসের বলে চার মেরে। এরপর ব্যক্তিগত ৩৭৫ রানের মাথায় ক্যাডিকের বলে হঠাতই আউট হয়ে যান লারা। যেভাবে খেলছিলেন তাতে ওই দিনই ৪০০ রানের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলাটা অসম্ভব মনে হচ্ছিল না মোটেও।
৭৬৬ মিনিট স্থায়ী, ৫৩৮ বলে ৩৭৫ রানের ‘স্ট্রোক ঝলমলে’ ইনিংসটাতে কোন ছক্কা ছিল না তবে বাউন্ডারি মেরেছিলেন ৪৫টা যার সবগুলোই এসেছিল গ্রাউন্ড শটে! লারাকে শুভেচ্ছা জানাতে সেদিন সরাসরি মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন স্বয়ং স্যার গ্যারি সোবার্স।