এক সাবানে কাপড় কাঁচা, সেই সাবানে গোসল

বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই বিজ্ঞাপন প্রিয়, এটায় কোনও সন্দেহ নেই।

বিজ্ঞাপনের ভাষায় তারা হন বিমোহিত, যেমন ধরেন আপনি অনেকদিন যাবত লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করেন, এখন লাক্সের আরও কাস্টমার ধরা দরকার, এবার আসবে নিউ লাক্স! একই মাল, প্যাকেটে দুইটা এক্সট্রা গ্রাফিক্সের কাজ সাথে নিউ লেখাটা বড় করে আর ভেতরে হাজার বছরের পুরনো সেই সাবান।

এখন এই সাবানের কাজ হলো গোসল করার, কিন্তু আপনাকে বিজ্ঞাপনে বলা হলো, ‘এক সাবানে কাপড় কাঁচা, সেই সাবানে গোসল।’

আপনিও একদম উচ্ছাসে আপ্লুত হয়ে প্রথম মুহূর্ত থেকে উদ্ভাসিত নয়নে চোখ মেলে সেই গোসল শুরু করলেন, আপনি আবেগে মাথায়ও সাবান দিলেন, চুল ডিহাইড্রেটেড হয়ে যাওয়া শুরু করলো, আপনি চোখ বিস্ফোরিত অবস্থায় সাবান ডলছেন, চোখ জ্বলা শুরু করলো, পুরো চাপটাই আপনার মনের ভেতর, আপনি গোসল করছেন, আপনি দেখলেন আপনার পানিই নেই, আপনি গোসল করার আগে আপনার পানি বরাদ্দ আছে কি নেই সেটাও খোঁজ নেননি, কেবলমাত্র নিউ শব্দটা আপনাকে আকৃষ্ট করেছে বলেই আপনি উল্লাসে গোসলে ঢুকে এখন জ্বলা চোখ এবং রুক্ষ হতে থাকা চুল নিয়ে আয়নার সামনে, সেখানে আপনার নগ্ন রূপ ভেসে উঠছে ঠিকড়ে পড়ছে!

এটাই হইছে বাংলাদেশ টিমের সাথে!

আমি অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, সেই মাশরাফির ২০১৯ বিশ্বকাপে ‘বিকল্প নাই কোটায়’ দলে থাকা নিয়ে, তামিম ইকবালের প্রেস কনফারেন্স নিয়ে আর ‘বাকিরা কে কী করেছে’ টাইপের ফালতু প্রশ্ন এখন সাকিব আল হাসান – এরা কেউই দলের জন্য আর খেলেন নি, খেলেছেন নিজের ইগোর জন্য, নিজেকে বাঁচাতে। মার্কেট ভ্যালু, মাঠের বাইরের ইমেজ, নিজের যোগ্যতার একটা মানদন্ড বজায় রাখতে। আর সাংবাদিকরা ধরে রেখেছে, ‘বাংলাদেশকে ভালোবাসলে এনাদের ভালোবাসতেই হবে মন্ত্র’।

‘সাকিব বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার’ – এই লাইন যতবার লিখবেন ততবার সত্যি এটা বারবার লিখে, এর বাইরে তিনি এখন যেটা করছেন সেটা ব্র্যান্ডিং, মোড়ক বদল, এই ব্র্যান্ডিংয়ে নিজেদের গা বাঁচানো কিছু কথা ছাড়া তার আর দেয়ার কিছুই নেই। এই যেমন গতকাল আমরা নিউ ব্র্যান্ডের সাবান যেটা দিয়ে কেবল গোসল করা যায় সেই প্যাকেট খুলে দেখলাম পুরনো নাইম শেখ, উনি ওপেনার, তাইলে সাকিব আল হাসানের বলা চিন্তার পরিবর্তন কোথায়?

রোহিত-রাহুল-কোহলি-জাদেজা-সুরিয়া-হার্দিক-পান্ত: এদের কি আপনার বোকা মনে হয়? যে এরা এই ব্যাটিং লাইন আপ নিয়েও টসে জিতে ব্যাটিং নেয় না? এরা আসলে পরিস্থিতিটা যাচাই করে, ভারতও নিউ ক্রিকেটে ঢুকছে, এটা রোহিত শর্মাও বলেছেন, কিন্তু এই কারণে এরা চোখ বন্ধ করে বল পেটাতেই যাননি, কোহলি ফর্ম খুঁজছেন, তিনি ৩৪ বলে ৩৫ রান করে পরিস্থিতি সেটেল করে দিয়ে গিয়েছেন, রাহুলের ১ বলে ০ রানের ইনিংসের ফায়দা নিতে দেননি পাকিস্তানকে।

আর আপনি দেখছেন শারজায় আগে ব্যাট করলে জেতে, আপনি ‘দুর্দান্ত ক্রিকেট মস্তিষ্ক’ ট্যাগ নিয়ে নিলেন ব্যাটিং, আপনিই না কইতেন, আপনার দল আপনার সিদ্ধান্ত হবে আপনার মতো, আপনি তো আগে পরের কারওই ব্যতিক্রম কিছু করলেন না। তার ওপর আপনার দল না পারে রহমতুল্লাহর মতো স্ট্রেইট ব্যাটে খেলতে, না পারে বাবর-রিজওয়ানের মতো ভিত গড়তে।

আচ্ছা বাংলাদেশে ফিরি! নতুন মোড়কে পুরনো সাবানের গল্প- এনামুল হক বিজয়, যিনি ১৪ বলে করেছেন ৫ রান, এখানে আমার মনে হয়েছে নাইম শেখ ভালো, আগে আউট হয়ে তিনি রক্ষা করেছেন।
এরপর সাকিব, দুই বলে দুই চার, মোমেন্টাম গেইন করার সময়, এটা ইব্রাহিম জাদরানের ইনিংস দেখলেও বলা যায় যে এই উইকেটে আপনাকে রান মেক করতে শুধু হিট করলে চলবে না, রান নিতে হবে, বড় বাউন্ডারি, আপনি সাকিব আপনি মারলেন শট সাইফুদ্দিন কায়দায়, এবং বোল্ড, টেইল এন্ডাররা এভাবে বোল্ড হয় সাধারণত।

আপনার সাথে আছেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, তামিম ইকবাল যাদের সাপোর্ট করায় যারপরনাই সমালোচনা হয়েছিল, আপনি সাকিব বলেই রক্ষা, আপনি তাদের রক্ষাকবচ দিলেন, দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে, আপনার দুই সেরা বড় ভাই ৩১ বল খেলে মোট ২৬ রান তুললেন।

একজনের স্বপ্ন ছিল রশিদ খানের বলে একটা ছক্কা মারবেন সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তিনি রশিদ খানের স্পেল শেষ হওয়ার দুই এক বল আগে আউট হয়ে গেলেন, তার মধ্যে একটা টিপি-কাল মধ্যবিত্ত দিন আনি দিন খাই বাঙ্গালী লুক আছে তাই রক্ষা, এই লুক নিয়ে পৃথিবীর যে কোনও মাঠে পার পাওয়া যায়, প্রবাসী বাঙ্গালী দশর্কদের সামনে পাওয়া যায় সমবেদনা, ও আর কী করবে যেই দলের ৩০ রানে ৪ উইকেট হাওয়া হয়ে যায়, সেটা চট্টগ্রামের মাটিতে টেস্ট হোক আর শারজায় টি-টোয়েন্টি।

এরপর আসেন শেখ মেহেদী! ইনি স্লগ হিটার, কালকে সেন্সিবল রোল প্লে করলেন, কিন্তু এনাকে স্লগ হিটার কেন বলা হয়? কেবল মিডিয়া বলে তাই? ওনার স্ট্রাইক রেট ১০৪, আরেক বিগ হিটার সাইফউদ্দিনের স্ট্রাইক রেট ১১৫।

যাই হোক, এবার সাবান কেনার আগের প্রক্রিয়ায় আসি, যে আপনার পানি নাই, মাঠে নেমে দেখলেন হুট করে আপনার একজন স্পিনার শর্ট, আপনি আপনার গত দুই বছরের সবচেয়ে সফল বোলার নাসুম আহমেদকে বাদ দিয়েই একাদশ গড়লেন, কী কারণে? আমার বদ্ধমূল ধারণা এটা ফেসবুকে ক্রীড়া সাংবাদিকদের একাদশ দেখেই আপনারা করেছেন, নাসুম সেখানে ছিলেন না, আপনিও রাখলেন না। একমাত্র মোসাদ্দেক যার ভালো খেলার মূল্য আপনারা দিতে পারেন নাই।

দুই উইকেট, ৪৮ রান- হার্দিক পান্ডিয়া মানের পারফরম্যান্স, সৈকতকে নিয়ে আজ কথা হচ্ছে না, কারণ আপনারা ওকে সহ ডুবিয়েছেন, সৈকত বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান ও সাহসী ক্রিকেটারদের একজন।

সৈকতেরই ছবি দিলাম, সৈকত ২০১৬ সাল থেকেই একটা জায়গার জন্য লড়ে গিয়েছেন, কখনো নিজেই নিজেকে ছোট করেছেন কখনো নির্বাচকরা কখনো কোরামের কারণে হয়নি- কিন্তু এবারে গোটা দল সৈকতের অনবদ্য অলরাউন্ড পারফরম্যান্সকে খাটো করলো।

সাকিব আল হাসান, ভালো বল করবেন, এটা অনুমেয়ই ছিল, করেছেনও। তার চেয়ে বেশি বলবো সাকিবের বলে আফগানিস্তান ভালো ব্যাটিং করেছে, কারণ ওরা চেয়েছে সাকিবের চারটা ওভার শেষ হোক, আমরা সময় পাবো, একই ভাবে আপনারা মুজিবের কথা ভাবেননি, আপনি ভেবেছেন ফরচুন বরিশালের নেটের প্র্যাকটিস এইটা, জোরের ওপর ব্যাট ঘুরাবেন মিরপুরের একাডেমি মাঠ পার করবে, সাংবাদিকরা লিখবে, ‘পাওয়ার ক্রিকেটে সাকিব শান দিচ্ছেন।’

সব ওমনে হয় না! স্কোয়াড তো বাজে ছিলোই, একাদশটা মনে হলো আরও বাজে!

এর চেয়ে টিকটকের স্লো মোশনে সুইচ হিট খেলা পোলাপান ধরে আনলে ওরা আমার ধারণা বেটার পাওয়ারপ্লে ডিসপ্লে দেখাতে পারবে। নিউ ব্র্যান্ডের ক্রিকেটে সাইফুদ্দিনকে নিয়েছেন, কিছুদিন আগে প্রমাণিত মৃত্যুঞ্জয়ের বদলে, তিনি আপনাকে ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে আপনি দুই উইকেট নেয়ার পর যেই উপহার দিয়েছিলেন, এবারও একই উপহার দিলেন- ২২ রান।

আপনি দেশের বাইরে এতোগুলো ম্যাচ খেলছেন বিভিন্ন ঘরোয়া লিগে, আপনার পেস বোলাররা ওয়াইড ইয়র্কার, স্লো বাউন্সার দিতে পারে না কেনো? মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে আলাদা করে কিছুই লিখবো না, আমি মনে করি ও সিনিয়র ক্রিকেটারদের চেয়েও বিষাক্ত, কারণ তার খেলা নিয়ে প্রশ্নও করা যায়না তাকে। দেব ভাইর সেই বক্তব্য নিয়ে আমারও আপত্তি ছিল যে কোনও ক্রিকেটারকে খারিজ করে দেয়া উচিত না, কিন্তু মুস্তাফিজুর রহমান নিজেই নিজেকে খারিজ করে দিয়েছেন।

এগুলো নিয়ে কি আলোচনাও হয়? সাকিব আল হাসান, আমার এখন মনে হয় আপনিও আপনার সাথের বাকি সিনিয়রদের মতো প্রেস কনফারেন্স ভিত্তিক দেখনদারি অধিনায়কত্ব করবেন, এবং পরে বলবেন, ‘জিতলে এই প্রশ্নগুলো করতেন না।;

শেষ একটা কথা বলি – মাহমুদউল্লাহ আর মোহাম্মদ নবির ব্যাটিংয়ে খুব বেশি পার্থক্য নেই, কিন্তু নবি টিমম্যান, সে জানে ওই সময় আউট হইলে দলেরই উপকার, সাইফউদ্দিনের সেই বলে আম্পায়ার আউট দেয়ার পর নন স্ট্রাইকার তাকে রিভিউ নিতে বলেছিল, কিন্তু নবি হাঁটা দিয়েছে, কারণ নবী নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সচেতন।

নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সচেতন থাকা মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link