রূপকথার রং আজ লাল। আর এই রূপকথার নায়ক বছর আঠাশের এক যুবক – রায়ান বার্ল।
সদ্য প্রয়াত রুশ কমিউনিস্ট নেতা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ প্রণিত ‘পেরেস্ট্রোইকা’র ছোঁয়া যেন লাগল আফ্রিকার দক্ষিণে অবস্থিত অর্থনৈতিক ভাবে ধুঁকতে থাকা এই দেশটির ততোধিক ধুঁকতে থাকা ক্রিকেটে। ধুলিস্মাৎ হয়ে যাওয়া ক্রিকেট গৌরব যেন আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল পুনর্গঠনের, পুণর্জন্মের।
সেই যেদিন ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামে ‘দানব’ হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন অধিনায়ক ডানকান ফ্লেচার, ব্যাট হাতে অপরাজিত ৬৯ এর পর মিডিয়াম পেস বোলিং এ ৪২ রানের বিনিময়ে চার উইকেট নিয়ে একাই গুড়িয়ে দিয়েছিলেন ক্যাঙ্গারুদের টপ অর্ডার, এরপর থেকে এই রূপকথা পর্যন্ত, দীর্ঘ ৩৯ বছরে একবারও কী কোনো একদিনের ম্যাচে বিদেশের মাটিতে হারাতে পেরেছিল তারা পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অজি বাহিনীকে!
তাঁদের সেই গৌরবময় সময়ে, যখন পরপর দুটি বিশ্বকাপের সুপার সিক্সে উঠে আসে তারা, যখন লাল জার্সিতে ব্যাট হাতে মাঠে নামতেন ফ্লাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়, নীল জনসন, অ্যালিস্টেয়ার ক্যাম্পবেলরা – নতুন বলের দায়িত্ব সামলাতেন হিথ স্ট্রিক, হেনরি ওলোঙ্গারা – লেগ স্পিনে ভেলকি দেখাতেন পল স্ট্র্যাং, যখন জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির দল পাঠানোর কথা ভুলেও ভাবতো না ক্রিকেটের সুপার পাওয়ার দলগুলো, তখনও তো দেশে বিদেশে একবারও হারানো সম্ভব হয়নি অস্ট্রেলিয়াকে।
কিন্তু, এবার কি হল? হোক না যতই ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেওয়া অস্ট্রেলিয়া, তৃতীয় ম্যাচে তো পূর্ণ শক্তি নিয়েই মাঠে নেমেছিল অ্যারন ফিঞ্চের দল। আর বিদেশের মাঠ তো বটেই, খোদ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কিনা অতিমানব হয়ে উঠলেন সেই বছর আঠাশের যুবকটি । ১০ রান খরচ করে তুলে নিলেন পাঁচ পাঁচটি উইকেট! যার মধ্যে আছে যে কোনো সময় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারা গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এবং শতরানের মুখে পৌছে যাওয়া ডেভিড ওয়ার্নারের উইকেট।
৫০ ওভারের খেলার পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা কিনা গুটিয়ে গেলেন মাত্র ১৪১ রানে! তারপর জবাবে দল যখন ১১৫ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে বেশ চাঁপে, তখন ব্যাট হাতে অধিনায়ক চাকাভার সাথে জুটি বেঁধে দলকে সেই তিনিই পৌছে দেন জয়ের দোরগোড়ায়।
বছর ছয়েক হতে চলল, খেলছেন এই লাল জার্সিতে। সেই যে একবার বছর তিনেক আগে এক কুড়ি বিশের ম্যাচে বাংলাদেশের সাকিব অল হাসানকে পিটিয়ে এক ওভারে ৩০ রান করেছিলেন এরপর আর তেমন নজর কাড়তে পারলেন কই? তবে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন একবার । ২০২১ সালের ২২ মে নিজের টুইটারে একটি ছবি পোস্ট করে তিনি লেখেন, ‘স্পন্সর পাওয়ার কোনো সুযোগ আছে কী? প্রতি সিরিজের আগেই আঠা দিয়ে জুতো সারাই করা আর কতদিন?’
ছবিটি ছিল একটি ছেঁড়া স্পোর্টস শু-কে আঠা দিয়ে জোড়া দেবার প্রচেষ্টা । এই একটি টুইট চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সে দেশের ক্রিকেটের অর্থনৈতিক দুর্দশার করুণ চিত্র। রাতারাতি অক্রিকেটীয় কারনে শিরোনামে উঠে আসে তার নাম। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ‘পুমা’। অপ্রিয় সত্য তুলে ধরার জন্য প্রশাসনিক রোষের মুখেও অবশ্য পরতে হয় তাঁকে।
আর আজ, মৃতপ্রায় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে কি নতুন প্রাণের সঞ্চার করলেন না তিনি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে গিয়ে পূর্ণ শক্তির অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ? প্রায় তলিয়ে যেতে বসা জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে কি তিনি আবার ফিরিয়ে আনলেন না নতুন উদ্যম , নতুন আত্মবিশ্বাস? জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ঐতিহ্যের ভেঙে পরা ইমারত কি আবার পুন:প্রতিষ্ঠিত হল না তাঁর সেই অতিলৌকিক পারফরমেন্সের কারণে? ঘরের মাঠে ‘দানব’ অস্ট্রেলিয়াকে হারানো কি আজকের জিম্বাবুয়ের জন্য ‘ডেভিড-গলিয়াথ’-এর রূপকথার থেকে কোনো অংশে কম?
আক্ষরিক অর্থেই পেরেস্ট্রোইকার সূচনা ঘটালেন তিনি নিজের দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে । এক কালে আঠা দিয়ে জুতো সেঁটে মাঠে নামতেন যারা, হয়তো তাদের পিছনে আবার ছুটবে স্পন্সররা । আর জিম্বাবুয়ে আবার স্বমহিমায় ক্রিকেট মানচিত্রে ফিরে এলে জয় হবে সেই ক্রিকেটেরই, জয় হবে ক্রিকেটেপ্রমী মানুষদের। আর এই জয়ের হাত ধরে যদি সত্যিই ঘুরে দাঁড়াতে পারে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট , তাহলে ইতিহাসের পাতায় কি অবশ্যই স্থান পাবে না এই আঠাশ বছরের রূপকথার নায়কের নাম?
জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের পেরেস্ট্রোইকা ঘটুক এই রূপকথার নায়কের হাত ধরেই । ইতিহাসে চিরস্থায়ী হোক হতদরিদ্র, মৃতপ্রায় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে রেনেসাঁ আনলেন যিনি সেই রায়ান বার্লের নাম।