কৃষিক্ষেত থেকে বিশ্বকাপের মাঠে

বাবার সাথে হালচাষ করছে মেয়ে। এমন একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো বছর দুয়েক আগে। এই সময়ে এসে হালচাষ করাটাই বিরল হয়ে উঠেছে। তবে মারুফা আক্তারদের জীবন জীবিকা নির্ভর করে তো এই কৃষি কাজ করেই। ফলে ছোটবেলা থেকেই মাটি সমান করা, গরুকে খাবার দেয়া এই কাজগুলো করেই অভ্যস্ত তিনি। অথচ এই মারুফার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ক্রিকেটের অমিত সম্ভাবনা। যা বারবার নিঙরে বের হয়ে আসতে চেয়েছে। আর সেই মারুফাই এখন খেলবেন বাংলাদেশের হয়ে।

নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায় বেড়ে উঠা মারুফা আক্তারের। বাবা অন্য লোকের জমিতে চাষাবাদ করেন। বাবা-মা ও চার ভাইবোন মিলে মোট ছয়জনের বড় পরিবার মারুফাদের। ফলে বাবা আইমুল্লাহ’র পক্ষে সম্ভব ছিল না কাউকে পড়াশোনা করানোর। ফলে সব ছেলেমেয়েই ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে চাষাবাদ করেছেন। যেমনটা করেছেন ১৬ বছর বয়সী মারুফাও।

তবে এইসবকিছুর পরেও একটা বিশাল স্বপ্ন নিজের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। বড় ক্রিকেটার হবেন, বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলবেন। তাঁর পরিবারের বাস্তবতায় ক্রিকেটটা তাঁর জন্য মোটামুটি নিষিদ্ধই, তবুও মারুফা নিজের স্বপ্নের জন্য লড়াই করেছেন। মারুফা প্রমাণ করে দেখালেন মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড় হতে পারে।

কৃষিকাজ করেও এলাকার মাঠগুলোতে ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যান মারুফা। তবে ক্লাস সিক্সে উঠার পর থেকেই ক্রিকেটের নেশাটা যেন আরো চেপে ধরে। বায়না ধরেন উপজেলায় গিয়ে ক্রিকেট শেখার। তবে বর্গাচাষী বাবার পক্ষে কী আর মেয়ের এই দাবি মেটানো সম্ভব। তবুও মারুফা লড়াই করে গিয়েছেন একাকী।

২০১৮ সালে নিজে নিজেই বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুযোগও পেয়ে গেলেন মারুফা। তবে সেবার তিনি ভর্তি হতে পারলেন না টাকার অভাবে। তবুও ক্রিকেট খেলাটা ছাড়েননি। এরপর সুযোগ পেলেন খুলনা বিভাগীয় দলে। আর ২০১৯ সালে জায়গা হলো বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলে।

তবে করোনার কারণে থেমে গেল সবকিছু। মারুফা আবার বাড়ি ফিরে গেলেন, দুবেলা খাবারের জন্য আবার বাবার সাথে নেমে পড়লেন কৃষিকাজে। এবার আর বুঝি কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না মারুফা। এই জনমে কী আর তাঁর ক্রিকেট খেলা হবেনা। কী করেই বা খেলবেন। ক্রিকেট ভুলে তখন পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেয়াটাই তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছিল।

আর বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলের ক্যাম্পে থাকা একজন ক্রিকেটারের এমন পরিস্থিতি নজরে পড়েছিল মানুষের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবা মেয়ের সেই ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল। বিষয়টা নজরে এসেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও (বিসিবি)। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বিসিবি। এরপর থেকে বিসিবিই নজরে রেখেছে এই ক্রিকেটারকে।

গতবছর নবম শ্রেণিতেও ভর্তি করে দেয়া হয় তাঁকে। আর এবার ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে রীতিমত আগুন ঝড়িয়েছেন এই পেসার। এবারের লিগে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। ১১ ম্যাচ খেলে তুলে নিয়েছেন ২৩ উইকেট। টুর্নামেন্টের সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারও হয়েছেন ১৬ বছর বয়সী এই নারী ক্রিকেটার। দারুণ এই পারফর্মেন্সের কারণে সুযোগ মিললো জাতীয় দলেও। বাংলাদেশের হয়ে মারুফাও খেলতে যাচ্ছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে। চাষের জমিতে ঘাম ঝড়ানো মেয়েটা এবার তাঁর বোলিং জাদু দেখাবে বিশ্বকাপের মত মঞ্চে।

মারুফার এই অদম্য সাহস ও কঠিন পথ পারি দেয়ার গল্পটা মানুষের সামনে তুলে আনতে চেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। দেশ ছাড়ার আগে তাই সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতির সাথে ছিলেন তিনি। এত আলো, এত ক্যামেরার শব্দের সাথে পরিচিত নন একেবারেই। তবুও ভাঙা ভাঙা শব্দে নিজের কথাগুলো বলছিলেন মারুফা।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link