প্রাক্তনের প্রত্যাবর্তন

ধ্বংসস্তুপ। ভারতের এবারের এশিয়া কাপ মিশনটাকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এভাবেই। ফেভারিট হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করলেও বিদায় নিতে হয়েছে ফাইনালের আগেই। তবে এবারের এশিয়া কাপে ভারতের সবচেয়ে বড় পাওয়া বোধহয় বিশ্বকাপের আগে বিরাট কোহলির ফর্মে ফিরে আসা। ফরিদ আহমেদের বলটাকে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে যেভাবে শতরানে পৌঁছালেন তাতে রোহিত শর্মা কিংবা শতকোটি ভারতীয় সমর্থকরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতে বাধ্য। 

সময়ের হিসেবে ১০২০ দিন। টানা তিন বছর ৭০তম সেঞ্চুরিতে আটকে ছিলেন বিরাট কোহলি। নানা চড়াই-উতরাই, আলোচনা-সমালোচনা সবকিছু মিলিয়ে মাঠের বাইরে যখন জেরবার অবস্থা, তখন কোহলি ভরসা রাখলেন নিজের পুরনো সঙ্গী ক্রিকেট ব্যাটটাকেই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে এতটাই সাবলীল ছিলেন কোহলি, সবাই ভাবছিল বছর পাঁচেক আগের সেই অমানবিক কোহলি বোধহয় ফিরে এসেছেন আবুধাবির স্টেডিয়ামে। 

নার্ভাস নাইন্টিনে সব ব্যাটসম্যানই কিছুটা চাপে থাকেন। হাজার হোক তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার বলে কথা। তার উপর যদি তিন বছর যাবত সেঞ্চুরির দেখা পাননি তাহলে তো আরাও চাপে থাকবেন। কিন্তু আফগানদের বিপক্ষে এতটাই সাবলীল ছিলেন, ঊনিশতম ওভারে ফরিদ আহমেদ যখন বোলিং এ আসলেন কোহলির চোখে-মুখে খেলা করছিল নিজের প্রতি অগাধ আত্নবিশ্বাস।

ফরিদ আহমেদ বলটা খুব একটা খারাপ করেননি, অল্পের জন্য লাইন মিস করেছিলেন। অন্যদিন হলে হয়তো এক কিংবা দুই রান হজম করতেন। কিন্তু দিনটা যে কোহলির, মনোমুগ্ধকর এক পুল শটে ডিপ মিডউইকেটের উপর সীমানাছাড়া করলেন। এ যেন সেই পুরনো টগবগে কোহলি, নিজের দিনে যিনি হয়ে ওঠেন অতিমানব।

দু:সময় পেড়িয়ে সুসময় আসলেই নাকি মানুষ ভুলে যায় বিপদের বন্ধুর কথা। যারা মনে রাখতে পারেন তারাই হয়ে ওঠেন মহামানব।  কোহলিও বোধহয় সাধারণের কাতারে পড়েন না, তাইতো সেঞ্চুরির পরই এগিয়ে যান সামনে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ দেন বিধাতাকে। এরপরই হাতের আংটিটাকে চুমু খেয়ে স্মরণ করেন সেই মানুষটিকে যে কিনা গত তিন বছরের প্রতিটা দিন পাশে থেকেছেন।

আশা রেখেছেন তার উপর, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন সামনে এগোনোর। তিনি কোহলির সহধর্মিণী আনুশকা শর্মা। মাঠ ত্যাগ করার আগে গ্যালারীর  দিকে তাকিয়ে হাসেন কোহলি, এত নির্মল-স্নিগ্ধ হাসি বহুদিন ক্রিকেট মাঠে দেখেনি বিশ্ববাসী। 

একবার ছন্দটা পাবার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কোহলিকে। বাজে কোনো শট খেলেননি, ভালো বলকে সম্মান দিয়েছেন। উইকেটের চারপাশে চোখ জুড়ানো সব শট খেলেছেন। সবাই যেন ফিরে গিয়েছিল ২০১৬ এর সেই ভিন্টেজ কোহলিতে। কোনো চাপ নেই, নির্ভীক-নিরলস ভঙিতে রান করে গিয়েছেন পুরোটা সময়। কব্জির মোচড়ে দারুণ সব ইয়র্কারকে সামলেছেন, লেংথ বলগুলোকে সুইপ করে মনোমুগ্ধকর ভঙিমায়। 

ভাল বলগুলো থেকেও অনায়াসে সব রান বের করে নিয়েছেন। যত সময় গড়িয়েছে, কোহলি তত আগ্রাসী হয়েছেন। নিখাদ টাইমিং আর গ্যাপ বের করতে দক্ষ কোহলির এমন ব্যাটিং দেখা ছিল চোখের শান্তি। দর্শকরাও যেন সব ব্যাটিং এ ডুবে গিয়েছিলেন। ম্যাচের স্কোর কিংবা ভারতের বিদায় কোনোটাই তখন তাদের ভাবনায় ছিল না। 

শিশু যেমন তার খেলনার নাড়ি নক্ষত্র সব জানে, কোহলিও যেন সেদিন আফগান বোলারদের পড়তে পারছিলেন। ফজল হক ফারুকিকে ডিপ স্কয়ারে মারা ছক্কাটার কথাই মনে করে দেখুন না। বোলার রানআপ নেয়া শুরু করতেই সামনে এগিয়ে এলেন যেন জানতেন ঠিক কোথায় বলটা করবেন ফারুকি এবং ডিপ স্কয়ারের উপর দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সীমানার বাইরে। এতটাই আত্নবিশ্বাসী ছিলেন শটের পর  বলের দিকে তাকাননি পর্যন্ত। শটের পর অপরপ্রান্তে থাকা ঋশাভ পান্তের অবাক অভিব্যক্তিই বলে দিয়েছিল কতটা অসাধারণ ছিল শটটা।

এদিন যেন কোহলি মনের আনন্দে ব্যাট করেছিলেন। সকলের প্রত্যাশার চাপ, সমালোচনার ঝড় কোনোকিছুই যেন স্পর্শ করতে পারেনি তাকে। ম্যাচ শেষের নির্মল হাসি, ঘামে ভেজা টিশার্ট, ডাগআউটে ফেরার সময় উঁচু করা ব্যাট সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় ফিরে আসার। ম্যাচ শেষে স্টেডিয়ামের বড়পর্দায় তাই একটা লেখাই ভাসছিল: ওয়েলকাম ব্যাক, কিং।

রাজা সত্যিই সেদিন ফিরে এসেছিলেন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link