ইলিয়াস সানির স্পিন ঘূর্ণিতে তখন একটু একটু করে স্বপ্ন বুনছিল বাংলাদেশ। সে সময়ের অস্ট্রেলিয়ার দলকে নাহয় টি-টোয়েন্টিতে হারানো যায়নি। তবে এবারের রোড সেফটি টুর্নামেন্টে ওয়াটসন, ব্রেট লিদের তখন পর্যন্ত হারানো খুব সম্ভবই মনে হচ্ছিল। শেষ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার ২১ রানের সমীকরণে সে সম্ভাবনায় বরং তীব্রতাই বাড়িয়েছিল। কিন্তু সেই চিরায়ত বাংলাদেশের মতোই তিক্ত যবনিকাপাত। আবুল হাসান শেষ ওভারে এসে ২১ রান দিলে তীরে এসে তরী ডুবে যায় বাংলাদেশ লিজেন্ডস দলের।
এই কিছুদিন হলো বয়স ত্রিশ পেরিয়েছেন আবুল হাসান রাজু। ক্রিকেটার হিসেবে ৩০ বছর বয়স বেশি নয়। অনেক দেশের ক্রিকেটাররা এই বয়সেই টেস্ট ক্রিকেট শুরু করেন। এ ছাড়া নিজের শেষ দেখেও অনেকে দমে যান না। দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে ক্রিকেট খেলে গেছেন। এই যেমন ৩৭ বছর বয়সে এসেও দীনেশ কার্তিক এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুযোগ পেলেন। ৪০ বছরে এসেও দাপুটে পারফরমেন্সে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন জিমি অ্যান্ডারসন।
তাঁরই আরেক সতীর্থ স্টুয়ার্ট ব্রড ৩৬ এ এসেও তরুণ পেসারদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে আছেন দলে। এরকম আরো অসংখ্য ক্রিকেটার রয়েছেন যারা ৩০ বছরের পরে এসেও দারুণ পারফর্ম করে ক্রিকেটে টিকে আছেন। কিন্তু আবুল হাসান রাজুর এই ৩০ বছর বয়সে এসে কেন লিজেন্ডস ক্রিকেটে খেলা লাগছে? লিজেন্ডস ক্রিকেট অবশ্যই কিংবদন্তীদের জন্য পুনর্মিলনীর এক মঞ্চ। কিন্তু সেই মঞ্চে ৩০ বছর বয়সী আবুল হাসান কতটা মানানসই?
ন্যূণতম মানদন্ডেও আবুল হোসেন রাজু বাংলাদেশের গ্রেটদের কাতারে পড়েন না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর খেলা ম্যাচসংখ্যা মাত্র ১৫ টি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে না খেলেও ক্রিকেটে অনেক গ্রেট হয়েছেন। কিন্তু সেসব ক্রিকেটারদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পরিসংখ্যান অনেক সমৃদ্ধ। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, আবুল হাসান রাজু তাঁর প্রায় এক যুগের ক্যারিয়ারে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন ৩৫ টি।
আর লিস্ট এ ক্রিকেটে খেলেছেন ৭৮ টি ম্যাচ। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আবুল হাসান তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন সেই ৫ বছর আগে, ২০১৭ সালে। অর্থাৎ ২৫ বছর বয়সেই নিজের শেষের শুরু দেখে ফেলেছিলেন তিনি। লঙ্গার ভার্সনে অনেকেই থিতু হতে পারেন না। অনেকেই শুধু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মনযোগ দেন। কিন্তু আবুল হাসানের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি।
তিনি কোনোটাতেই থিতু হতে পারেনি। ২০১৮ সালেই খেলে ফেলেন নিজের শেষ লিস্ট এ এবং টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। অবশ্য আবুল হাসানের পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই শত্রু হয়ে আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল ইনজুরি। কিন্তু প্রশ্ন হল, ২৬ বছর তো একজন ক্রিকেটারের ক্রান্তিলগ্ন না। এখান থেকেই শুর করা যায়। সেই নতুন শুরুর প্রচেষ্টা কতটা ছিল আবুল হাসানের মাঝে? আদৌ কি ছিল?
অথচ কী দুর্দান্তভাবেই না টেস্ট ক্যারিয়ারটা শুরু করেছিলেন তিনি। টেস্ট অভিষেকেই করলেন সেঞ্চুরি। ১০ নম্বর ব্যাটার হিসেবে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। আবুল হাসানের মূল শক্তির জায়গাটা ছিল বোলিংয়ে। কিন্তু, বাংলাদেশে ক্রিকেটে সেটি দেখা গিয়েছে কমই। যেটুকু লাইম লাইট তিনি পেয়েছিলেন তা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঐ অবিশ্বাস্য ইনিংসের কারণেই। এরপর তিনি হারিয়ে গেছেন। কখনো ইনজুরির কারণে ব্রাত্য হয়েছেন, কখনো নিজের অফফর্মের কারণেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা হেলায় হারিয়েছেন।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তেমনভাবে কখনোই যে উন্নতির চেষ্টা করেননি সেটার স্পষ্ট ছাপ তাঁর ক্যারিয়ার জুড়েই। সব মিলিয়ে ৫১ টা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। চোখের লাগার পারফরম্যান্স বলতে একবার ৫ উইকেট নিয়েছেন। কিন্তু বাকিটা সময় দু’হাত ভরে ব্যাটারদের রান দিয়েছেন। ইকোনমিটা ৯.৩০। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সে চিত্রটা আবার আরো খারাপ, ইকোনমি ১০.৫৭।
নক্ষত্ররাজি আসে, আবার আঁধারে মিশে যায়। আবুল হাসান রাজু বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোনো নক্ষত্র না। তবে যে সম্ভাবনা নিয়ে তিনি এসেছিলেন তাতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি হতেই পারতেন। কিংবা ইনজুরির বাঁধা ডিঙিয়েও ফিনিক্স পাখির মতো আবারো ফিরে আসতে পারতেন। কিন্তু নিজের শেষ তিনি অনেক আগেই দেখে ফেলেছেন এবং সেটা মেনেও নিয়েছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো আভাসই দিতে পারেননি। হয়তো সেটা তাঁর সামর্থ্যের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিল। তাই আবুল হাসান রাজুর ‘ক্রিকেটার’ পরিচয়টা রয়ে গেছে আলস্যে, আক্ষেপে, আবডালে।