রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উইকেট তাঁর দখলে। অথচ দুই দশকের ক্যারিয়ারে এক বারের জন্যও ডাক পাননি জাতীয় দলে। বড্ড ভুল সময়ে তার আগমণ হয়েছিল ভারতের ক্রিকেট পাড়ায়। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় ছিলেন বিষাণ সিং বেদির আড়ালে। তবে এ নিয়ে আফসোস ছিল না সদা হাস্য মানুষটার। যে জার্সিই গায়ে জড়িয়েছেন, নিজের সর্বোচ্চটাই দিয়ে গিয়েছেন। তিনি রাজিন্দর গোয়েল, ভারতীয় ক্রিকেটের ‘গোয়েল সাব’।
হরিয়ানায় জন্ম নেয়া রাজিন্দর গোয়েলের ক্রিকেটের প্রেমে পড়া ছোটেবেলাতেই। তবে প্রথম নজর কাড়েন ১৬ বছর বয়সে, সেবারের স্কুল ক্রিকেটে জেতেন সেরা বোলারের খেতাব। ফাইনালে চার উইকেট নিয়ে উত্তরাঞ্চলকে চ্যাম্পিয়ন করাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে থেকে। রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক পরের মৌসুমেই। পাতিয়ালার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটের যাত্রাটা শুরু হলেও রঞ্জি ট্রফিতে খেলেছেন বিভিন্ন দলের হয়ে। সাউদার্ন পাঞ্জাব, দিল্লির হয়ে খেলার পর অবসর নিয়েছেন জন্মস্থান হরিয়ানার হয়েই।
বাঁ-হাতি স্পিনার গোয়েলের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল লম্বা সময় ধরে বল করতে পারতেন। তাছাড়া তার লাইন-লেংথও ছিল ভীষণরকম ভালো। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত উইকেট নিলেও ভারতের বিখ্যাত ‘স্পিন কোয়াট্রেট’ এর আবির্ভাবের কারণে জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ মেলেনি। বিশেষ করে জাতীয় দলে তার লড়াই ছিল বিষেণ সিং বেদীর সাথে। দুজন একই ঘরানার বোলার হলেও বেদির হাতে বৈচিত্র্য ছিল অনেক বেশি।
অনেকের মতে ভুল সময়ে তার আগমণ না হলে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা স্পিনার হওয়ার সামর্থ্য ছিল তার। তবে শ্রীলংকার বিপক্ষে আনঅফিশিয়াল এক টেস্টে ভারতের হয়ে মাঠে নামেন তিনি। সেবার দ্বিতীয় ইনিংসে চার উইকেট নিয়ে জানান দিয়েছিলেন নিজের সামর্থ্যের। ১৯৮০ সালে ভারত সফরে কিম হিউজের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে নিয়েছিলেন নয় উইকেট। তবে একবার জাতীয় দলে খেলার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন রাজিন্দর গোয়েল।
১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ভারত সফরে এসেছিল ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্যাঙালুরুতে প্রথম টেস্ট শুরু হবার আগে বিষেণ সিং বেদি দল থেকে নাম সরিয়ে নিলে জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় গোয়েলের জন্য। সবাই ধরেই নিয়েছিল এবার জাতীয় দলে অভিষেক হবে তার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেবারও অজ্ঞাত কারণে জাতীয় দলে খেলা হয়নি তাঁর।
জাতীয় দলে না হলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে গিয়েছেন নিয়মিতই। ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে ভাঙেন ভমন রমনের গড়া রঞ্জি ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪১৭ উইকেটের রেকর্ড। অবসর নেবার আগের মৌসুমের চন্দ্রকান্ত পন্ডিতকে আউট করে স্পর্শ করেন ৬০০ উইকেটের মাইলফলক। তার ৬০০ উইকেট প্রাপ্তির পর ঘটেছিল এক অদ্ভুত ঘটনা।
গোয়ালিয়র কারাগার থেকে বুখা সিং নামক এক কুখ্যাত ডাকাত চিঠি লিখেছিলেন তাকে অভিনন্দন জানিয়ে। জানিয়েছিলেন গোয়েল সাবই তাঁর দেখা সেরা স্পিনার। বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে এই ঘটনা বিরল। বুঝিয়ে দেয় জাতীয় দলে না খেললেও গোয়েলের জনপ্রিয়তা ছিল কোন পর্যায়ে। সুনীল গাভাস্কার তাকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘হাসিমুখের হন্তারক’ নামে।
কোনো সন্দেহ ছাড়াই হরিয়ানা থেকে আসা সেরা ক্রিকেটার কপিল দেব। কিন্তু তার আগমণের পূর্বে হরিয়ানাকে বহু বছর একা হাতে টেনেছেন রাজিন্দর গোয়েল। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে অবসর নেয়ার আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শিকার করেন ৭৫০ উইকেট। ৫৯ বার ম্যাচে পাঁচ বা ততোধিক উইকেট শিকার করেছেন। ক্রিকেট মাঠ ছাড়লেও খেলাটাকে ছাড়তে পারেননি গোয়েল।
হরিয়ানা এবং বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের নির্বাচকের ভূমিকায় ছিলেন অনেক দিন। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজের ছেলেকেও বানিয়েছেন ক্রিকেটার। তার ছেলে নিতিন গোয়েলও হরিয়ানার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন। ২০১৭ সালে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরষ্কার সিকে নাইডু ট্রফি সম্মাননায় ভূষিত করা হয় তাকে। যে সম্মাননা তাকে তুলে দিয়েছিলেন স্বয়ং বিষেণ সিং বেদী।
২০২০ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন রাজিন্দর গোয়েল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ না পেলেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে। জাতীয় দলে খেলেও যে সম্মান অনেকেই পান না, জাতীয় দলে না খেলেও সেটা ঠিকই পেয়েছিলেন ‘গোয়েল সাব’।