কপিল, এখন অবসরে যাবার সময়!

সরে যাবার সময়, কিন্তু থেকে যান। দমে যাওয়ার পাত্র না। আরও কিছু সময় কাটিয়ে দেওয়ার অভিলাষ। এমন ভাবে বাইশ গজের অদ্ভুত মায়ায় ক্রিকেট মাঠ থেকে আড়ালে যেতে চান নি ইতিহাসের অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার। আর কখনোই দেশের জার্সিতে মাঠে নামা হবে না? এমন হৃদকম্পন বাড়ানো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হয়তো এদের অনেকেই নিজের শেষ দেখে ফেলেন। তবুও রয়ে যান সুপ্ত আশায়, ভরসায়। সে সব আশা ভরসা এক সময় নিভে যায়। নিজের ইচ্ছায় সরে না দাঁড়ালেও এক সময় থামতে বাধ্য হন। 

কপিল দেব, একটি নাম, একটি পরিচয়। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক। ভারতীয় পেসার হিসেবে এখনো সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার তিনি। তাই ভারতের আকাশে বড় এক নাম কপিল দেব। তবে কিংবদন্তিদেরও তো প্রস্থান হয়। কপিল দেবের ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছিল। 

১৯৯৪ সালের কথা। ৪ বছর আগে অবসর নেওয়া রিচার্ড হ্যাডলি তখনো টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার। তবে কপিল দেবের সামনে সে বছরে সুযোগ রয়েছে হ্যাডলিকে ছাপিয়ে যাওয়ার। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আহমেদাবাদ টেস্টেই হ্যাডলির ৪৩১ টেস্ট উইকেটের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ডটি নিজের করে নেন কপিল। বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে।

ক্যারিয়ারে একশোর বেশি টেস্টও খেলা হয়ে গিয়েছে ততদিনে। আবার বয়সটাও ৩৫ পেরিয়েছে। পেসারদের জন্য এই ৩৫ বয়সটাই তো অনেক। তাই ভারতীয় নির্বাচকরা সে সময় ধরেই নিয়েছিলেন, কপিল দেব হয়তো এবার অবসর নিতে চলেছেন। তাই কপিল দেবের সাথে আপাতত এ বিষয় নিয়ে তারা আলোচনায় না বসলেও পারে। 

কিন্তু হঠাৎই সে সময়ে ভারতের প্রধান নির্বাচক গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ এক সকালে পত্রিকা খুলে দেখলেন, কপিল দেব আরো দুই বছর খেলা চালিয়ে যাবেন বলে বিবৃতি দিয়েছেন। অথচ নির্বাচক হিসেবে তাদের কপিলকে নিয়ে এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা নেই৷ বিশ্বনাথ তাঁর আরেক নির্বাচক বন্ধু অংশুমান গায়কোয়াড়কে দেখালেন সে খবরটা। বিশ্বনাথ ছিলেন ইন্ট্রোভার্ট ধরণের মানুষ। কোনো ধরণের বিতর্কে তিনি জড়াতে চান না। তাই কপিল দেবের সাথে সরাসরি আলোচনার দায়িত্বটা তিনি গায়কোয়াড়কে দিলেন। গায়কোয়াড় আবার বন্ধু ছিলেন কপিলের, এখনও আছেন।

ভারতের ক্রিকেটে তখন পর্যন্ত সবচেয়ে নামী ক্রিকেটার কপিল দেব। সেই কপিল দেবের সাথে আলোচনায় বসতে হবে বিব্রতকর এক বিষয়বস্তু নিয়ে। এর সাথে এমন আলোচনায় কন্ট্রোভার্সি শুরু হতে কতক্ষণ, এমন শঙ্কা তো আছেই।  সব ধরনের ভাবনায় অংশুমান গায়কোয়াড় নিজেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। তারপরও প্রধান নির্বাচক বিশ্বনাথের কথা মতো তিনি কপিল দেবের সাথে আলোচনায় বসতে রাজি হলেন।

তার আগে সে সময়ের বিসিসিআই সভাপতি জাগমহন ডালমিয়ার সাথে তারা তাদের এ পরিকল্পনার কথা জানান। ডালমিয়ারও তেমন কোনো আপত্তি ছিল না। কারণ কপিল দেবের তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নতুন করে দেওয়ার কিছু ছিল না। বরং কপিল খেলে গেলে এজন তরুণ ক্রিকেটারের উঠে আসার পথটা বন্ধ হয়ে যেত। তাই কপিল দেবের সাথে অবসরের বিষয়ে আলোচনটা করাই শ্রেয়।  

এরপর সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টের টি-ব্রেকের মাঝে গায়কোয়াড় ড্রেসিংরুমে একান্ত আলোচনার জন্য কপিল দেবকে ডেকে পাঠালেন। বিব্রতকর প্রসঙ্গ। তারপরও গায়কোয়াড়কে বলতে হবে অকপটে। গায়কোয়াড়ও এক নিশ্বাসে বলে ফেললেন, ‘ক্যাপস, নির্বাচকরা মনে করছে তোমার এখনই থামা উচিত এবং তুমি নিজেও সেটা জানো। আমরা তোমাকে অবশ্যই একটি ফেয়ারওয়েল ম্যাচ দিব। তবে তোমার অবসরের ঘোষণাটা বোধহয় দিয়ে ফেলা উচিত।’ 

গায়কোয়াড়ের এমন কথায় কপিল দেবও সেটা মেনে নিলেন। এক হাত বাড়িয়ে গায়কোয়াড়ের সাথে করমর্দনে জানালেন, ‘ধন্যবাদ।’ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তখন চলমান ঐ ম্যাচটিই কপিল দেবের জন্য হয়ে যায় দেশের মাটিতে খেলা শেষ টেস্ট। কপিল দেব এর এক মাস পরেই সেডন পার্কে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। 

গ্রেট ক্রিকেটাররা হয়তো এমনই হয়। নিজের চাওয়ায় দলের বোঝা হয়ে থাকতে চান না। বরং টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে আসা যে কোনো বার্তা ইতিবাচক ভাবে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। বিব্রতকর যেকোনো প্রসঙ্গও সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা রাখেন। কপিল দেবও তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ফুলস্টপ বসিয়েছিলেন এমন বিনম্রতায়, বিনীত চলনে। কারণ বাইশ গজের কপিল দেব যে মাঠের বাইরেও সমান ভাবে অনুকরণীয়। 

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link