সৌরভ জমানা শেষ, রজার বিনির নতুন অধ্যায় শুরু। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের ৩৬তম সভাপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিলেন রজার বিনি। একই সাথে সভাপতি হিসেবে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপজয়ী কোনো ক্রিকেটারকে পেলো বিসিসিআই। এর আগের সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি ছিলেন প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক যিনি বিসিসিআইয়ের মসনদে বসেছিলেন।
২০১৯ সালে অনেক সম্ভাবনা নিয়ে বিসিসিআই সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। তিন বছরের এ যাত্রায় কলকাতার যুবরাজ কতটুকু সফল ছিলেন? সম্ভাবনার কতটুকু অংশ তিনি পূরণ করতে পেরেছিলেন? এমন পর্যালোচনায় মিশ্র ফলই আসবে। তাঁর তিন বছরের এই সময়কালে করোনায় থমকে গিয়েছিল পৃথিবী।
তারপরও সেই সময়ে তিনি আইপিএল আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু সভাপতি হওয়ার সময় যে কথাগুলো তিনি বলেছিলেন তাঁর সবকিছুই কি তিনি করে যেতে পেরেছেন? অবশ্যই না। অবশ্য বাস্তবিক অর্থে ভাবলে, মাত্র তিন বছর সময়কালে সব কিছু সম্পন্ন করাও সম্ভব না।
২০১৯ সালে বিসিসিআই সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার সময় সৌরভ গাঙ্গুলি বলেছিলেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের নিয়ে তাঁর আলাদা পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনায় তারা অগ্রাধিকার পাবে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের আলাদা একটা চুক্তিতে আনা হবে। কিন্তু ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এর কোনো অগ্রগতির দেখা মেলেনি সৌরভ গাঙ্গুলির সময়ে। প্রথম শ্রেণির কোনো ক্রিকেটার চুক্তিতে আসেনি।
এ ছাড়া ২০২০ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রানার্স আপ হয়ে ৫ লক্ষ ডলার প্রাইজমানি পেয়েছিল ভারত। কিন্তু বিসিসিআই নারী ক্রিকেটারদের প্রাইজমানি হাতে তুলে দিয়েছিল ফাইনাল ম্যাচেরও পনেরো মাস পর। অথচ বিসিসিআই আইসিসির কাছ থেকে প্রাইজমানির অর্থ পেয়েছিল ফাইনাল হওয়ার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই। এখানে অবশ্য দায়টা সৌরভ গাঙ্গুলির একার না। সাংগঠনিক কিছু জটিলতার কারণেই এই বিলম্ব হয়েছিল।
সৌরভ গাঙ্গুলির সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুটি হলো, সৌরভ-বিরাট কোহলি দ্বন্দ। অবশ্য সৌরভ বরাবরই এটিকে ভুল বোঝাবুঝি হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। সব সময়ই বিরাট কোহলিকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। এমনকি কোহলি বাজে সময়েও পাশে ছিলেন সৌরভ। তবে বিতর্কটা তৈরি হয়েছিল গত বছরে হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর।
সে বিশ্বকাপের পর টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন কোহলি। তবে এর কিছুদিন পরেই ওয়ানডে অধিনায়ক থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয় কোহলিকে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, সাদা বলের ক্রিকেটে ভিন্ন অধিনায়ক রাখতে চায় না বিসিসিআই। একই সাথে এটিও দাবি করা হয়, কোহলির সাথে আলোচনা সাপেক্ষেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু, কোহলি সেটা পরবর্তীতে অস্বীকার করেন। আর এখান থেকেই বিতর্ক শুরু হয়। এমনি কোহলি প্রকাশ্যে পরোক্ষভাবে সমালোচনাও করে বসেন। অবশ্য সৌরভ গাঙ্গুলি সেটি নিয়ে তেমন প্রত্যুত্তর করেননি। তবে সে সময়ে এটি নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনার জন্ম হয়েছিল।
তবে সৌরভ গাঙ্গুলির সময়ে ক্রিকেটাররা বেশ উপকৃতও হয়েছে। সামনে বছর থেকে শুর হতে যাওয়া নারী আইপিএলের সব কিছু চূড়ান্তকরণ হয়েছে তাঁর সময়েই। এ ছাড়া প্রথম প্যান্ডামিকের সময়েই ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই একমাস আগেই কুলিং অফ পিরিয়ড নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। সেই রায়টা বিসিসিআই-এর পক্ষেই আসে। অর্থাৎ, এর আগে লোধা কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, রাজ্য সংস্থা বা বিসিসিআই-এ কোনো ব্যক্তি একটানা ছয় বছর কোনো পদে থাকলে তাঁকে তিন বছরের জন্য বাধ্যতামূলক ‘কুলিং অফ’ পিরিয়ডে যেতে হতো।
কিন্তু এখনকার নিয়মে সেটি আর নেই। টানা ছয় বছর পদে থাকলেও কুলিং অফ পিরিয়ডে যাওয়ারও বাধ্যবাধকতা নেই। সেই হিসেবে আরও এক মেয়াদ বিসিসিআই এর প্রেসিডেন্ট থাকতে পারতেন সৌরভ গাঙ্গুলি। এমনটাই ধারণা করছিল সবাই। কিন্তু এক মাস বাদেই সব কিছু পাল্টে যায়। সৌরভ গাঙ্গুলিকে একপ্রকার বিসিসিআই থেকে সরিয়েই দেওয়া হয়।
অনেকের ধারণা মতে, এখানে রাজনৈতিক কিছু স্বার্থসংঘাতও জড়িত। আর বিসিসিআই-এর সঙ্গে যে সব সময়ই রাজনীতি জড়িত তা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। এই যেমন বিসিসিআই এর বর্তমান সচিব জয় শাহ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহর পুত্র। গুঞ্জন উঠেছিল, জয় শাহই পরবর্তী সভাপতি হবেন। কিন্তু কোনো আলোচনা না থাকা রজার বিনি হঠাৎ কিভাবে এই দৌড়ে ঢুকে গেলেন তা এখনও রহস্যের।
সৌরভ গাঙ্গুলির পরবর্তী গন্তব্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন বেঙ্গলে। এরই মধ্যে জানা গিয়েছে তিনি সিএবি’র প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করবেন। অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে রাজ্যে ফিরছেন কলকাতার মহারাজা। অবশ্য আগামী ২১ অক্টোবর পর্যন্ত আইসিসি চেয়ারম্যানের মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় আছে। তবে এখানে বিসিসিআই থেকে তেমন ইতিবাচক সমর্থন পাননি সৌরভ। তাই আইসিসির চেয়ারম্যান হওয়ার পথটা একটু সরুই হয়ে গিয়েছে সৌরভের জন্য।
২০০০ সালের মধ্যম শক্তি মত্তার এক ভারত দলকে সৌরভ তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন শীর্ষে। ধোনি না সৌরভ, কে সেরা অধিনায়ক তা নিয়ে বিতর্ক এখনও হয়। সময়ের বিবেচনায় অনেক সময় সৌরভকেই এগিয়ে রাখা হয়। তবে জাতীয় দল থেকে সৌরভের প্রস্থানটা হয়েছিল অনেকটা নিরবেই। এবার বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট থেকে বিদায়ের সময়ও নিরব তিনি। হয়তো এটাই একজন ব্যক্তি সৌরভের ব্যক্তিত্বের মহিমা।
বিসিসিআই থেকে বিদায়কালে সৌরভ বলেছেন, সামনে তাঁর আরও অনেক বড় পরিকল্পনা আছে। সে পথেই তিনি হাঁটছেন। সৌরভের সে পথযাত্রা নিশ্চয় সৌরভময়ই হবে।