রূপকথার সেই অ্যাডিলেডে আরেকবার

রুবেল হোসেনের ছোঁড়া পরপর দুটি বল। না, দুটি উপাখ্যান। কমেন্ট্রিবক্স থেকে ভেসে আসছে শব্দ গুলো। ‘গোউজ ফর হিরো। বোল্ড হিম। ফুল অ্যান্ড স্ট্রেইট। দ্য বাংলাদেশ টাইগারস হ্যাভ নকড দ্য ইংলিশ লায়নস, আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ। ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট ডেইজ ইন দ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট হিস্টোরি, ওয়ান অব দ্য লোয়েস্ট পয়েন্টস ইন ইংলিশ ক্রিকেট।’

শব্দ গুলো এখনো একটা রূপকথার মত শোনায়। নাসের হুসেইনের সেই ধারাভাষ্য এখনো কোথাও বেজে উঠলে ক্রিকেট ভক্তরা শিহরিত হন, গায়ে কাটা দেয়। সেই দৃশ্যের প্রতিটা পরত এখনো চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে। জিমি অ্যান্ডারসনের স্ট্যাম্পটা উড়িয়ে দিয়ে দুহাত প্রসারিত করে রুবেলের দৌড়।

ছুটতে থাকা রুবেলকে জড়িয়ে ধরতে চাইছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। রুবেল থামেন না, তাঁর এই ছুটে চলা যেন অনন্ত পানে। ওদিকে মাঠের একটা পাশে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। ক্রিকেট তাঁকে এতটা ফিরিয়ে দিবে তিনি বোধহয় কল্পনাও করতে পারেননি। মাশরাফির শরীরে উপর নিজের গা টা এলিয়ে দিলেন তাসকিন। এরপর রিয়াদ, সৌম্য, রুবেল একে একে পুরো দলটা। যেন অধিনায়কের প্রতি একটা সম্মান জানানো।

২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডকে হারানোর সেই স্মৃতি এখনো তরতাজা। নাসের হুসেইনের ভাষায় ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট ডেইজ ইন দ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট হিস্টোরি। ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে দিলো বাংলাদেশ। নিজেরা প্রথমবারের মত জায়গা করে নিল বিশ্বকাপের কোয়াটার ফাইনালে।

সেই অ্যাডিলেড ওভালে আরেকবার পৌছেছে বাংলাদেশ। প্রায় সাত বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপের ম্যাচ। এবার প্রতিপক্ষ ভারত। আবারো সেই অ্যাডিলেড, আবারো একটা ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ দল। এই জয়টাও সেদিনের মত পালটে দিতে পারে বিশ্বকাপের অনেক সমীকরণ।

২০১৫ সালে জয়টা এসেছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এবার খেলাটা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে, ভারতের বিপক্ষে। পরিস্থিত, প্রতিপক্ষ, কন্ডিশন, ফরম্যাট সবকিছুই বাংলাদেশের প্রতিকূলে। তবুও মন যে বারবার মনে করিয়ে দেয় সেই স্মৃতি। সাকিব, সৌম্যরা অ্যাডিলেডে পা দিয়েই নিশ্চয়ই সেদিনের কথা ভেবেছেন।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে এই প্রথমবারের মত দুইটি ম্যাচ জিততে পেরেছে বাংলাদেশে। কাগজে কলমে এখনো বাংলাদেশ সেমি ফাইনালের দৌড়ে টিকে আছে। যদিও বাস্তবতা আরো অনেক কঠিন। তবে নেদারল্যান্ড কিংবা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই জয় গুলো নিয়েও হাস্যরসের কিছু নেই।

অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে নেদারল্যান্ড যোগ্য দল হিসেবেই মূল পর্বে খেলতে এসেছে। আর জিম্বাবুয়েতো ঠিক আগের ম্যাচটাতেই পাকিস্তানকে হারিয়ে এলো। বরং বাংলাদেশই মানসিক ভাবে পিছিয়ে ছিল নিজেদের ফর্ম বিবেচনায়। আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন ছোট দল, বড় দল বলেও কিছু নেই।

ফলে এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফর্মেন্সের প্রশংসা করতে হবে। তবে এই বিশ্বকাপটা আরেকটা ইতিহাস হয়ে থাকতে পারে অ্যাডিলেডে আরেকটা রূপকথা লেখা গেলে। এবার অধিনায়ক মাশরাফি নেই, সাকিব আছেন। হিরো হবার জন্য রুবেল নেই, তাসকিন আহমেদ আছে। ব্যাটিং লাইন আপ সামলানোর জন্য রিয়াদ নেই, লিটন-আফিফরা আছেন।

আরেকবার এই অস্ট্রেলিয়ায়, আরেকবার খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা দল, আরেকবার একটা ইতিহাসের হাতছানি। বাংলাদেশের কাছে হেরে সেদিন বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ডের। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচেও সমীকরণটা অনেকটা সেরকমই। এমনকি এই জয়টা পেলে বাংলাদেশের সেমি ফাইনালের রাস্তাও অনেকটাই প্রশস্ত হয়ে যায়।

সেমিফাইনালের হিসেব মিলুক কিংবা নাই মিলুক। ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপে একটা জয় পেলে সেটা হবে এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশ নতুন করে যে পথচলা শুরু করেছে, সেই পথটা যে সঠিক সেটারও একটা বার্তা মিলবে।

তবে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে কাজটা বাংলাদেশের জন্য সহজ নয়। জিততে হলে বাংলাদেশকে নিজদের সর্বোচ্চটা দিতে হবে। সাথে ভারতের প্রতিটা ভুলের স্বদব্যবহারও করা চাই। তাহলেই হয়তো অ্যাডিলেডে লেখা হতে পারে আরেকটি উপাখ্যান। হয়তো আরেকবার কমেন্ট্রিবক্স থেকে ভেসে আসবে তাসকিন, লিটন, আফিফ, কিংবা সাকিব গোউজ ফর হিরো। হিস্টোরি ফর বাংলাদেশ।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link