বিরাট কি সত্যিই ফেক ফিল্ডিং করেছেন?

অ্যাডিলেডে বাংলাদেশ-ভারত লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটেছে নানান বিতর্কের জন্ম দিয়ে। ম্যাচ শেষ হলেও বিতর্কের রেশ আছে। মূলত নুরুল হাসান সোহান ম্যাচ শেষের পর সাংবাদিকদের সামনে এসে প্রকাশ্যে ভারতের ফেক ফিল্ডিং নিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন। তবে নির্দিষ্ট করে তিনি কারও নাম বলেননি। আর এর পরেই রাত পেরোতে না পেরোতেই দেখা গেল, সেই ফেক ফিল্ডিংটি করেছেন বিরাট কোহলি। এমসিজি’র আইন অনুযায়ী, ফেক ফিল্ডিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যাটিং দল ৫ টি রান পেনাল্টি পাবে। বাংলাদেশ ম্যাচও হেরেছে ৫ রানে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সে বিষয় আলোচনা হচ্ছে বিস্তর। 

তবে সব কিছু ছাপিয়ে এ ম্যাচে প্রশ্ন উঠতে পারে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত নিয়ে। প্রথমত, আউটফিল্ড ভেজা থাকার পর বৃষ্টির পর খেলা শুরুর ব্যাপারে তাদের উপর প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ বৈশ্বিক একটি টুর্নামেন্টে মাঠ পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত না হওয়ার পরও খেলা শুরু করা বেশ দৃষ্টিকটু দেখায়, অনেক প্রশ্নের জায়গা তৈরি করে। তবে দুই অধিনায়কই যখন মত দিয়েছেন, তাই সে বিষয় নিয়ে শেষ পর্যন্ত গভীরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। তবে ম্যাচজুড়ে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক। 

দীনেশ কার্তিকের রান আউটটি নিয়েই কথা বলা যেতে পারে।  মাঠের দুই আম্পায়ার সিদ্ধান্তটি তুলে দিয়েছিলেন তৃতীয় আম্পায়ারের উপর। সেখানে দেখা গেল, শরিফুল যখন স্ট্যাম্পে বল লাগালেন তার কয়েক ন্যানো সেকেন্ড আগেই এলইডি স্ট্যাম্প জ্বলতে শুরু করেছে।

অর্থাৎ শরিফুলের হাত আগে স্ট্যাম্পে লেগে আলো জ্বলেছে কিনা সেই প্রশ্ন থাকছেই। অথচ থার্ড আম্পায়ার সেটি আউট দিয়ে দিলেন মুহূর্তের মধ্যেই। অথচ তার উচিত ছিল, আরও কয়েকটি অ্যাঙ্গেল দেখে পরিষ্কার হয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া। যাহোক, যেহেতু এ সিদ্ধান্তটি সব ধরনের টেকনিক্যাল উপাদানের আশ্রয় নিয়েই দেওয়া হয়েছে, তাই এটি নিয়ে বড় জোর মৃদু প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু পরের ঘটনাটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় অনায়াসেই। 

এমসিসির আইন অনুযায়ী বলা যায়, বিরাট কোহলি ফেক ফিল্ডিং করেছেন। এমসিসির আইন বলে, স্ট্রাইক প্রান্তের ব্যাটার বল খেলার পরে যদি কোনো ফিল্ডার ইচ্ছাকৃতভাবে, কথা দিয়ে কিংবা কাজে, ব্যাটারের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে, ধোঁকা বা বাঁধা দিতে চেষ্টা করে, সেটা অন্যায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিরাট কোহলি কি ব্যাটারদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন? কিংবা মনসংযোগ অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন? এখন এটি নিশ্চিত হতে গেলেও তো আম্পায়ারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ লাগবে। অথচ যতদূর জানা গিয়েছে, নাজমুল শান্তর তাৎক্ষণিক অভিযোগ আমলেই নেয়নি অন ফিল্ডে থাকা আম্পায়ারদ্বয়। 

প্রশ্নটা তাই আম্পায়ারদের পেশাদারিত্ব নিয়েই। বাংলাদেশ সেই ফেক ফিল্ডিং থেকে ৫ রান পেত কিনা সেটা অন্য আলাপ। কিন্তু মাঠের ভিতর ঘটা এতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আম্পায়ারের চোখ এড়িয়ে গেল। সেটি যেতেই পারে। কিন্তু খেলোয়াড়ের তোলা অভিযোগের প্রতি এত উদাসীনতা নিয়ে আম্পায়াদের অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। 

টেকনিক্যালি ক্রিকেট নিখুঁত একটি খেলা। প্রযুক্তি কিংবা সেটার আদলে ডিআরএস যেটাই বলি না কেন, এমন কিছু থাকার পরও আম্পায়ার সেটির কেন সহায়তা নিলেন না, সেটি নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যায়।

এখন আম্পায়ারদের স্বপক্ষে একটি যুক্তিই আসতে পারে। ফেক ফিল্ডিংয়ের জন্য ৫ রান পেনাল্টির ব্যাপারটা তেমন ভাবে কোনো ম্যাচে প্রয়োগই হয়নি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে একবার হয়েছিল অবশ্য। ২০১৭ সালে প্রথম বারের মত ফেক ফিল্ডিংয়ের জন্য দলকে ৫ রানের জরিমানায় ফেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মার্নাস লাবুশেন। ঘরোয়া ক্রিকেটের এক ম্যাচে তিনি ফিল্ডিংয়ের সময় ডাইভ দিয়ে বল না ধরতে পারলেও উইকেট রক্ষক বরাবর থ্রো করার ভান করেন। আর এতেই প্রতিপক্ষ দল ৫ রানের বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল।   

ফেক ফিল্ডিং এর কারণে ৫ রানের জরিমানার দৃষ্টান্ত ঐ একটিই। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন দৃশ্য কখনোই দেখা যায়নি। তবে ২০১৯ সালের অ্যাশেজে ফিরে যাওয়া যেতে পারে। ৫ম টেস্টের দ্বিতীয় দিনের খেলায় বল ধরে উইকেট ভেঙে ফেলার অভিনয় করেন ইংল্যান্ডের জনি বেয়ারস্টো। স্টিভ স্মিথও ঠিক সে সময়ে ডাইভ দিয়ে ফেলেন নিজেকে বাঁচাতে।

তার দুই বছর আগে ২০১৭ সালেই ফেক ফিল্ডিং নিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করে এমসিসি। তারপরও জনি বেয়ারস্টোর সে ফিল্ডিংয়ে ফেক ফিল্ডিং হিসেবে গণ্য করা হয়নি। আর সে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার স্কোরের সাথেও ৫ রান যোগ হয়নি। মূলত এটি আম্পায়ারদের উপর নির্ভর করে। তাদের কাছে সেটি দৃষ্টিকটু লাগলেই তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ফেক ফিল্ডিংয়ের ভিত্তিতে পেনাল্টি দিতে পারেন।   

অর্থাৎ এমসিসি এমন আইনের সাথে এর ভিতরে আরও অনেক কিছু ক্রাইটেরিয়া যুক্ত করে দিয়েছে। সেটি অনেকটা আম্পায়ার্স কলের মতোই আম্পায়ারদের মনগড়া সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করে। গলদটা আসলে এখানেই। অনেকটা পরীক্ষায় একেক প্রশ্ন একেকভাবে উত্তর দেওয়ার মত। কিন্তু, এটা কিন্তু প্রশ্ন উঠানোর মতোই বিষয় যে, সিদ্ধান্ত না হয় পরেই আসুক। সেটি বিবেচ্য বিষয় না। কিন্তু আম্পায়াররা প্রসেসটা তো ফলো করবেন। একজন ফুটবল রেফারি যেমন গোল কিংবা ডি বক্স ফাউলের জন্য ভিএআরের শরণাপন্ন হন তেমন ক্রিকেট মাঠেও কেন দুই আম্পায়ার ডিআরএসের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিবেন না? 

মূলত এই ব্যাপারগুলোই প্রশ্নের খোরাক জোগায়, আম্পায়ারদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মাঠের আম্পায়ার ভুলের ঊর্ধ্বে নন। এটা একদম নির্জলা সত্য। কিন্তু ন্যূনতম একটা অভিযোগ আমলে নেওয়া কিংবা সব কিছুকে সমান গুরুত্ব দিয়ে পুনর্বিবেচনা করলেই তো এমন সব বিতর্কের জন্ম হতো না। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে তাই আম্পায়ারের দায় নিশ্চিতভাবেই আছে। আর সেটা নিয়ে আলোচনার জায়গাটাও প্রবল। 

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link