কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়!

জেমকন খুলনার সেদিনের ম্যাচটাতে মাশরাফির একটা ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে। ছবিটাতে দেখা যায়, মাশরাফির সার্জারি করা পায়ে তিনি খেলার মাঝেই শুশ্রুষা নিচ্ছেন। সেই পায়ে আবার রাজ্যের ব্যান্ডেজ (ব্যান্ডেজ শব্দটা ঠিক উপযুক্ত হল না, আসলে মেডিকেলের ভাষাতে কি বলে জানি না)।

যা হোক, এই ছবিটা দেখে কোথায় জানি একটা ধাক্কা লাগল। একজন মানুষ এত কষ্ট সয়ে ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন, ক্রিকেটের প্রতি ঠিক কতটা ভালবাসা থাকলে এই ব্যাপারটা সম্ভব হয়? ঠিক কতখানি আবেগে ক্রিকেটকে নিজের আবেগে পুষে রাখলে এভাবেও মাঠে নামা যায়?

ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। মাশরাফির নির্বিকার মুখটাই চোখ কাড়ছিল সবচাইতে বেশি। এভাবে খেলে যাওয়া যেন এই লোকটার কাছে দিব্যি সাধারণ কোন অফিস ওয়ার্ক।

এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘুরতে ঘুরতে দেখি সেখানেও ঘুরছে মাশরাফির সেই ছবি। এখান থেকে একটা ব্যাপার মনে হল, বেশিরভাগ মাশরাফি ভক্তের কাছে মাশরাফি যেন শুধু এই কষ্ট সয়ে খেলে যাওয়া আবেগ হিসেবেই বেঁচে আছেন। অথচ, কলার উঁচু করে দৌড়ে আসা পাগলাটার বেঁচে থাকা দরকার অধিনায়কত্ব, ক্রিকেটার, বোলার এসবের মাপকাঠিতে।

আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কিন্তু মোটেও বলছিনা মাশরাফির এই ত্যাগকে আপনি মনে রাখবেন না বা রাখা উচিত না। অবশ্যই উচিত। জীবনের যেকোন বড় পরীক্ষাতে আপনি একবার মাশরাফির দিকে তাকালেই অনেক কিছুর অর্থই আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু আমি যেটা বলছি, আপনি যদি মাশরাফিকে শুধু এই আবেগেই বাঁচিয়ে রাখেন, সেটা মাশরাফির প্রতি অবিচার হয়ে যাবে। মাশরাফির সবচাইতে বড় পরিচয় ক্রিকেটে, ক্রিকেটার হয়ে!

বাংলাদেশের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে দুটো বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাশরাফি। বিশ্বকাপে খেলোয়াড় হিসেবে চার বিশ্বকাপ খেলা একমাত্র খেলোয়াড়ও মাশরাফি। আপনি স্রেফ একবার ভাবুন তো, নিজের পারফর্ম্যান্সের ধারাবাহিকতা ঠিক কতটা বেশি হলে, দলে নিজের ইমপ্যাক্ট ঠিক কত দীর্ঘ সময় ধরে টানা জারি রাখতে পারলে একজন খেলোয়াড় চারটে বিশ্বকাপ খেলতে পারে?

অধিনায়ক হিসেবেও মাশরাফি অতুলনীয়। বাংলাদেশের হয়ে মোট ৮৮ ওয়ানডেতে নেতা হয়ে মাঠে নেমেছেন মাশরাফি। এই ৮৮ ওয়ানডের ৫০ টাই তিনি জিতে নিয়েছেন। অধিনায়ক হিসেবে এত বেশি ম্যাচ জেতা আর এত বেশি উইনিং পারসেন্টেজ এর আগের বাংলাদেশী অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, সাকিব আল হাসান, মোহাম্মদ আশরাফুল, মুশফিকুর রহিম, খালেদ মাসুদ পাইলট কারোরই নেই। মাশরাফির সময়েই বাংলাদেশ সাউথ আফ্রিকা, পাকিস্তান, ভারতকে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে সিরিজ হারিয়েছে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমি ফাইনাল খেলেছে, বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে, দেশের হয়ে একমাত্র ট্রাই নেশন ট্রফিটাও জিতেছে।

আজকাল তো বাংলাদেশ বেশ ভাল মানের বোলার পেয়েছে, অন্তত অভিষেক ম্যাচগুলিতে তাঁদের পারফর্ম্যান্স আকাশ ছুঁয়ে যায়। আপনি কি জানেন, এখনও ওয়ানডেতে যেকোন একটা ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে সবচাইতে সেরা বোলিং ফিগারটা মাশরাফিরই – ২৬ রান দিয়ে ৬ উইকেট, ইকোনমি রেট ২.৬০! মুস্তাফিজুরের সেই চমক জাগানিয়া অভিষেক ম্যাচ, তাসকিনের আগুনে অভিষেক স্পেল, এত কিছুর পরও এক ওয়ানডে ম্যাচে সবচাইতে সেরা বোলিং ফিগারটা কিন্তু মাশরাফিরই!

শুধু কি তাই, ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচাইতে বেশি উইকেট নেওয়ার তালিকাতেও প্রথম বোলারটার নাম মাশরাফি বিন মুর্তজায়। সাকিব আল হাসান হয়তো তাকে ছাড়িয়ে যাবেন, কিন্তু এত লম্বা সময় ধরে নিজের পারফর্ম্যান্স টিকিয়ে রেখে এই যে তিনি ওয়ানডেতে একটা দেশের সর্বোচ্চ উইকেট টেকার- এটা কি কম বিস্ময়ের?

বাংলাদেশের সবচাইতে সফল অধিনায়কও কিন্তু মাশরাফিই। সব ফরম্যাট মিলিয়ে তিনি দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১১৭ ম্যাচে, যার মধ্যে ৬১ ম্যাচেই তিনি জিতেছেন। এই উইনিং পারসেন্টেজে তাঁর ধারেকাছেও দেশের কেউ নেই।

ঘরোয়াতেও নিজের ক্যারিশমাটিক অধিনায়কত্ব বজায় রেখেছেন মাশরাফি বহাল তবিয়তেই। ছয়বার আয়োজিত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের চারবারের চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়কের নাম মাশরাফিই। তাও তিনি জিতেছেন ভিন্ন তিন ফ্রাঞ্চাইজির হয়ে। সবসময়েই যে সেরা দল পেয়েছেন তাও কিন্তু নয়। রংপুর রাইডার্সের মত তারকাখচিত দল যেমন পেয়েছেন, পেয়েছেন গোণায় না থাকা প্রথম আসরের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কাপ্তানীও। দল কখনও বড় ব্যাপারই হয়নি অধিনায়ক মাশরাফির কাছে, তিনি ট্রফি জিতেছেন অনায়াসেই। এই ব্যাপারটি কি কম রোমাঞ্চকর?

শুধু কি তাই? একইসাথে বোলার ও অধিনায়ক হিসেবে একশো উইকেটের কীর্তি আছে পুরো ক্রিকেট ইতিহাসেই মাত্র চারজনের। এই চারজনের একজনের নাম মাশরাফি। এই বিরল তালিকায় বাকি তিনজন হলেন- ওয়াসিম আকরাম, শন পোলক, ইমরান খান। মাশরাফির অবস্থান এতটাই উচ্চে!

শুধু তাই না, আর মাত্র ২১ উইকেট আর ৯২ রান করলেই তিনি সব ফরম্যাট মিলিয়ে ৪০০ উইকেট আর ৩০০০ রানের কীর্তিটা করে ফেলবেন, সাকিব আল হাসানের সাথেই!

এতসব কিছু লেখার কারণ কি? এসব তো আমরা অনেকেই জানি। এর কারণ হল, আমার ধারণা মাশরাফি ঠিক তাঁর প্রাপ্য মর্যাদাটা পান না। আমি যদি কোন একজন মাশরাফি ভক্তকে জিজ্ঞেস করি, আপনি ঠিক কি কারণে মাশরাফিকে ভালবাসেন? সেই উত্তর দিতে গিয়ে কেন জানি সবাই বক্তব্যের বেশিরভাগ অংশে সার্জারী, কষ্ট সয়ে খেলে যাওয়া এসব টেনে আনেন। কিন্তু আমি যদি সাকিবের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি, সেখানে পরিসংখ্যান, ক্রিকেট এসবই কেন যেন বেশি থাকে।

আর এখানেই আমার মনে হয় মাশরাফিকে ছোট করা হয়। মাশরাফির মূল পরিচয় ক্রিকেটার। তাকে নিয়ে আগে আমাদের গর্ব করা উচিত ক্রিকেটে। এই সার্জারী সয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়া এসব নিয়েও আমরা কথা বলব, আবেগপ্রবণ হব, কিন্তু ক্রিকেটার মাশরাফিকে যদি এসবের নিচে চাপা দিয়ে ফেলি, তাহলে তো মাশরাফির দৌড়টাই অপ্রাপ্তিতে থেকে গেল!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link