প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ইংলিশ ক্রিকেটের হর্তাকর্তার কাউন্টি ক্রিকেটে বিদেশিদের জায়গা দিতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁদের ভাষায় ‘কলোনিয়াল’ ক্রিকেটাররা যেন সহজে ইংল্যান্ডে খুঁটি গেড়ে বসতে না পারে সে জন্য নিয়মের প্রচুর কড়াকড়ি ছিল। এই ‘কলোনিয়াল’ টার্মটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ক্রিকেট খেলার বিস্তারের সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ওতপ্রেতভাবে জড়িত। টেস্ট খেলা প্রায় প্রতিটি দেশই একসময় ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল। এই ফাঁকে বলে রাখি ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ ধারণাটাও ব্রিটিশদের মস্তিস্কপ্রসূত, মূলত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে একসময়ে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের একীভূত স্টেট সৃষ্টির ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
যাই হোক, কাউন্টি ক্রিকেট প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেখানে বিদেশি খেলোয়াড়দের আনাগোনা উল্লেখযোগ্য আকারে শুরু হয় ১৯৫০-৬০ এর দিকে। এর মধ্যে আরো একটি বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। স্বাধীন হয়েছে উপমহাদেশ; দক্ষিণ আফ্রিকা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটীয় নেশন হিসেবে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ট্যুর করতে আগের মত দীর্ঘ সময় লাগছে না।
তার চেয়েও বড় কথা অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের বাইরেও ক্রিকেটাররা আক্ষরিক অর্থেই পেশাদার হয়ে উঠছেন। ফলে ইংল্যান্ডের বাইরের অনেক ক্রিকেটারই জাতীয় দলের পাট চুকোলে ইংল্যান্ডে ইমিগ্রেশন নিয়ে সেটেল হয়ে কাউন্টিতে খেলতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া দীর্ঘদিন চেপে বসে ছিল ইংলিশ ক্রিকেটের উপর, সেখানে রং ছটান এই দেশত্যাগী ক্রিকেটাররা।
কাউন্টি ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা ১৯৬৮ সালে। কাউন্টি দল নটিংহ্যামশায়ারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে প্রত্যেক ক্লাবকে ১ জন ননরেসিডেনশিয়াল ক্রিকেটারকে দলে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়, পরে সেটা বাড়িয়ে ২ করা হয়। নটিংহ্যামশায়ার এর জন্য প্রস্তুতই ছিল; বাৎসরিক ৭০০০ পাউন্ড বেতন, একটা অ্যাপার্টমেন্ট আর নিজস্ব গাড়ির বিনিময়ে তারা চুক্তি সই করে স্যার গারফিল্ড সোবার্সের সাথে।
৩১ আগস্ট, ১৯৬৮; সোবার্স ম্যালকম ন্যাশের এক ওভারের ৬ বলের ৬টিতেই ছক্কা হাঁকালেন, কাউন্টি ক্রিকেট প্রবেশ করলো নতুন যুগে।
সেসময়ে কাউন্টি ক্রিকেটের উত্থানের পিছনে আরো দুটো ঘটনা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। তার একটা হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উত্থান। সত্তর-আশির দশকের ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের দলে নেয়ার জন্য সঙ্গত কারণেই উন্মুখ হয়ে ছিল কাউন্টি দলগুলো। দর্শকদের কাছে বড় আকর্ষণ ছিল উইন্ডিজ ক্রিকেটের মহিরুহদের একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে দেখা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেটা সম্ভব হয় না। সে সময় অনেক বড় মাপের উইন্ডিজ ক্রিকেটার টেস্ট দলে জায়গা পাচ্ছিলেন না, তারা মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন কাউন্টি ক্রিকেটে।
সিলভেস্টার ক্লার্ক, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৯.৫২ গড়ে ৯৪২ উইকেট; মাত্র ১১টি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন, খেলতেন সারের হয়ে। মিডলসেক্সে ছিলেন ওয়েইন ড্যানিয়েলস, ২২ গড়ে ৮৬৭ উইকেট প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে, টেস্ট খেলেছেন মাত্র ১০টি। দ্বিতীয়টি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার উপর নিষেধাজ্ঞা। দক্ষিণ আফ্রিকানরা নিজেরাও তাদের স্বর্ণযুগ পার করছিল, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যারি রিচার্ডস, মাইক প্রক্টর, ক্লাইভ রাইসদের জন্য কাউন্টি ক্রিকেটই সর্বোচ্চ মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায়। প্রক্টরের দল গ্লাউস্টারশায়ারকে লোকে প্রক্টরশায়ার ডাকতে শুরু করে, এতটাই প্রভাব ছিল এই কিংবদন্তী অলরাউন্ডারের।
কাউন্টি ক্রিকেট উন্নতির চরম শিখরে পৌছায় ৮০’র দশকে। ১৯৮১ সালে অ্যাশেজ শুরুর কদিন আগে সমারসেট বনাম ল্যাঙ্কাশায়ার ম্যাচটি ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেসময় সমারসেটে ছিলেন ভিভ রিচার্ডস, ইয়ান বোথাম আর জোয়েল গার্নার। অন্যদিকে ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে খেলছিলেন ক্লাইভ লয়েড ও মাইকেল হোল্ডিং।
ম্যাচটা সমারসেট জেতে ৩৩ রানে। গার্নার দুবার পাঁচ উইকেট নেন, হোল্ডিং এক বার, বোথাম ম্যাচে ছয় উইকেট। রিচার্ডস প্রথম ইনিংসে ৮২ করলেও পরের বার সুবিধা করতে পারেননি, দুবারই হোল্ডিং এর বলে আউট হন। একই ভাবে ক্লাইভ লয়েডও গার্নারের বলেই দুই ইনিংসে আউট হন। এছাড়া রিচার্ড হ্যাডলি আর ক্লাইভ রাইস তখন নটিংহ্যামশায়ারে, অ্যান্ডি রবার্টস আর ম্যালকম মার্শাল হ্যাম্পশায়ারে, ইমরান সাসেক্সে। জিওফ্রে বয়কট একবার বলেছিলেন তার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রানগুলোর মূল্য টেস্ট রানগুলোর চেয়ে কম নয়, কথাটা একদম অযৌক্তিক নয়।
আশির দশকের ধারা নব্বইতেও অব্যাহত ছিল। কাউন্টি দলগুলোর মধ্যে ইয়র্কশায়ার সবসময়ই একটু আলাদা; জাতীয় দলে সবচেয়ে বেশি ক্রিকেটার তারা যোগান দিয়ে এসেছে। তাই দীর্ঘদিন স্বেচ্ছায় ওভারসিজ ক্রিকেটার সাইন করায়নি। সেই নীতি থেকে সরে এসে প্রথম যাকে তারা দলে নিল তার নাম শচীন টেন্ডুলকার। অভিষেকেই ম্যালকম মার্শালকে খেললেন ১৯ বছর বয়সী টেন্ডুলকার, রান আউট হবার আগে ৮৬ রান করেছিলেন। টেন্ডুলকার সেখানে বেশিদিন ছিলেন না, কিন্তু কাউন্টিতে নন রেসিডেনশিয়াল স্টার ক্রিকেটারের অভাব হয়নি তখনো।
ল্যাঙ্কাশায়ারে ওয়াসিম, ওয়াকার প্রথমে গ্ল্যামরগানে, তারপর সারেতে, কোর্টনি ওয়ালশ গ্লাউসেস্টারশায়ার, এলান ডোনাল্ড ওয়ারউইকশায়ার, অ্যামব্রোস নর্দাম্পটনশায়ারে। কিন্তু নব্বইতেই ওয়ানডে ক্রিকেট তার আধুনিক রূপ পায়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পরিমাণ বেড়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার নিষেধাজ্ঞা ফুরায়, ক্রিকেট ততদিনে তার ইংল্যান্ড কেন্দ্রিক নেই। ফলে ধীরে ধীরে কাউন্টি ক্রিকেট তার আকর্ষণ হারায়।
শেন ওয়ার্ন, গ্রায়েম স্মিথ বা হালের কুমার সাঙ্গাকারার মত কিংবদন্তিরা কাউন্টিতে খেলেছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা ক্যারিয়ার যখন মধ্য গগনে তখন নয়, বরং বিদায় বেলায় এসে। আয়রনি হচ্ছে, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দুইয়েরই জন্ম কাউন্টি ক্রিকেটে, আর তাদের হাতেই কাউন্টি ক্রিকেটের পতন। চারদিনের টেস্ট আর ইসিবির নতুন ১০০ বলের ক্রিকেট আইডিয়া যদি বাস্তবায়িত হয় তবে তার ফলও ইংলিশ ক্রিকেটকেই ভোগ করতে হবে।