সম্প্রতি ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ামি ইনফ্যান্তিনো একটা কথা বলেছেন। বলেছেন, ‘আমি একজন ইউরোপিয়ান। গত কয়েক শতাব্দী ধরে আমরা বিশ্বে যা করেছি, কোনও নৈতিকার পাঠ পড়ানোর আগে আমাদের উচিত পরের তিন হাজার বছর ধরে শুধু ক্ষমা চাওয়া।’
আতস-কাচের তলায় এরকম একটা কথাকে ফেলে পর্যবেক্ষণের কোনও দরকারই পড়ে না। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেই বোঝা যাবে ইউরোপীয়রা কোন কোন দেশে ঠিক কী কী নমুনা ফেলে রেখেছে। ফুটবলও কি তার ব্যতিক্রম? নয় তো। ‘খেলাতে আবার রাজনীতি টানা কেন!’ – অফকোর্স! ফুটবল এমন একটা খেলা যার ছত্রে ছত্রে রাজনীতির বোড়ে লুকিয়ে রয়েছে।
বাটপার সেপ ব্লাটার ফিফা প্রেসিডেন্ট থাকার সময় কাতারকে বিশ্বকাপ পাইয়ে দেওয়ার বিতর্কের টাটকা গন্ধ এদিক ওদিকে এখনও ঘুরছে। ফুটবলের প্রোগ্রেশনে কাতার ম্যানেজমেন্টের ভূমিকা কতটা— তার হদিস কেউ জানে না। শুধু জানে, ২০০২-এ জাপান, সাউথ কোরিয়ার পর কোনও এশিয়ান কান্ট্রিতে ফুটবল বিশ্বকাপ হচ্ছে। যেখানে তাপমাত্রার বাড়বাড়ন্ত এমনই, শীতকালে বিশ্বকাপ করতে হচ্ছে ফুটবল লিগ সিজন এক মাসের জন্য বন্ধ রেখে। এবং কাতারই বিশ্বে প্রথম ফুটবল দল, যারা ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতে চলেছে এর আগে কোনও একটা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ না করেই।
অদ্ভুত! পর্যাপ্ত স্টেডিয়াম না থাকায় কাজ করতে আসা শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটেছে। শারীরিক হেনস্থার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কত নিরীহ শ্রমিক। সেই ধ্বংসযজ্ঞের ওপর অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এমন একটা মঞ্চ যাকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। বয়কটের ডাক দিয়েছে বহু দেশ, বয়কট করছেন বহু প্রাক্তন খেলোয়াড়, কমেন্টেটর। অনেক দিন আগে এরিক কতোঁনা বলেই দিয়েছেন, ‘ঐ রক্তের মধ্যে চলা বিশ্বকাপ আমি দেখতে পারব না।’
তবুও, বিশ্বকাপ। পৃথিবীতে সব ভুলে মানুষ রাত জেগে থাকবে। ঠায় বসে থাকবে ৯০ মিনিট ধরে। পিছিয়ে যাই আজ থেকে বছর বারো আগে। সেবারে জঙ্গল, পাহাড়ের মধ্যে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিলেন কেষ্টবিষ্টুরা। যে বিশ্বকাপ, ১৯৯৮ পরবর্তী জেনারেশনের বেড়ে ওঠার কারিগর। আজ আর বিতর্ক নয়, আজ আর টেকনিক্যালিটি নয়, নিখাদ নস্টালজিয়া। যুক্তি-প্রযুক্তির কচকচির মধ্যে একটু ঠাণ্ডা প্রয়োজন। তাই কিছু ভাল লাগার মুহূর্তকে নিয়েই আরও একবার ফিরে দেখার প্রচেষ্টা বিশ্বকাপের মহল।
২০১০ বিশ্বকাপের আগে ২০০৮ ইউরো কাপের কথা না বললেই নয়। এবং ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক। যেখানে তৎকালীন তরুণ প্রতিভাবান অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার গোলে নাইজেরিয়াকে হারিয়ে সোনা জিতল আর্জেন্টিনা। রিকেলমের সেটাই আর্জেন্টিনার হয়ে শেষ ম্যাচ। ২০০৮ ইউরোতেও ভাগ্য খুলল না জার্মানির। তোরেসের রান আটকাতে পারল না লাম। ২০১০ এ যাওয়ার আগে স্পেন টিম গোছাতে শুরু করে ২০০৬ থেকেই। ফলে, প্রত্যেক পজিশনে সেরা এবং ইনফর্ম প্লেয়ার পেয়েছিল।
৪-৩-৩ এ গোলে ক্যাসিয়াস, ডিফেন্সে পুওল, পিকে, রামোস আর ক্যাপদেভিলা। মিডে জাভি, ইনিয়েস্তা, বুস্কেটস আর অ্যাটাকে ভিয়া-তোরেস-পেদ্রো। আর এর বাইরে বেঞ্চে কারা? জাভি আলান্সো, খুয়ান মাতা, সেস্ক ফ্যাব্রেগাস, আরবেওলা, জেসাস নাভাস, লরেন্তে আর গোলের ব্যাক আপ ভিক্টর ভালদেস! এমন টিম বোধহয় শতাব্দীতে আর আসেনি। জিততই বিশ্বকাপ, সন্দেহ নেই। কিন্তু শুরুতেই অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছিল ওটমারের সুইজারল্যান্ড।
অনেক প্লেয়ারের শুরুর সাক্ষী ২০১০ বিশ্বকাপ। চোটের জন্য মাইকেল বালাক খেলতে পারল না। বদলে ১৩ নম্বর জার্সি পরল থমাস মুলার বলে একটা নতুন ছেলে আর ছারখার করে দিল সব। নিজের প্রথম বিশ্বকাপে জিতে নিয়েছিল গোল্ডেন বুট। সেবারে হিগুয়েন সাউথ কোরিয়ার বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক করেছিল। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার পরে আজও একমাত্র আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার যার বিশ্বকাপে একটা হ্যাট্রিক আছে। মারাদোনার বেখাপ্পা স্ট্র্যাটেজিতে সব ভেসে গেলেও টিম হিসেবে খুব খারাপ ছিল না আর্জেন্টিনা। যদিও রিকেলমে আর জানেত্তি অদূরে কোথাও মুচকি হেসেছিলেন। যে লোকটা ইন্টারকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতালো, তাকেই বেমালুম বাদ দিয়ে দিল দু’হাতে ঘড়ি পরা মারাদোনা!
বেশ মনে পড়ে, নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে কাকার হতাশ চোখ। ফেলিপে মেলোর পাস থেকে রবিনহোর গোল অব্দিই ব্রাজিল খেলল, তারপর ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারল খেলতে শুরু করল। নেদারল্যান্ডসের মিডফিল্ড সে সুযোগ কাজে লাগাতই। শুধু স্পিডে না পেরে মাইকন রবেনকে বেমক্কা ফাউল করে বসল। কাকার চ্যানেল বন্ধ আর ফেলিপে মেলোর রেড কার্ড সব নষ্ট করে দিল।
কোয়ার্টারে স্নেইডার একা হাতে ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। যদিও ব্রাজিল সেবার টিম হিসেবেও সুবিধের ছিল না। লুইস ফ্যাবিয়ানো বলে একটা স্ট্রাইকার কেন নাম্বার নাইন জার্সিটা কলঙ্কিত করেছিল আজও ভেবে পাই না। বদলে নেদারল্যান্ডস টিম হিসেবে এত ভাল ছিল, কিন্তু ফাইনালে ঐ খেলা! প্লাস রবেনের শট আটকে যাওয়া ক্যাসিয়াসের কাছে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।
যদি কেউ প্রশ্ন করে, ২০১০ বিশ্বকাপ কেন এত প্রিয়? কী এমন খনি লুকিয়ে রয়েছে ২০১০ বিশ্বকাপেই, যে এখনও রেশ ভোলা যাচ্ছে না? যদি ১ নম্বরের প্রশ্ন ধরে নিই এটা, তাহলে উত্তর হয় দুটো শব্দে। ডিয়েগো ফোরলান।
তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল সব। ওরকম একটা খুনি শিল্পীকে দেখলে কার মাথার ঠিক থাকে! ম্যাজিকটা শুরু হয়েছিল মেক্সিকো ম্যাচ দিয়ে। তারপর এল কোয়ার্টারে সেই বিখ্যাত ঘানা ম্যাচ। সুয়ারেজের হাত দিয়ে গোললাইন সেভ। ফোরলানের ফ্রি কিক।
ফ্রি কিকটা দেখবার মত ছিল। ইনসাইড কার্ল, রেনবো – মাঠের যে কোনও কোণ থেকে শট নিয়ে গোল করার অদ্ভুত ক্ষমতা। সেই থেকে ফোরলানে মজে যাওয়া। সাইবার ক্যাফে থেকে ফোরলানের ঐ দু’হাত ছড়িয়ে দৌড়ের বিখ্যাত ছবিটা ডাউনলোড করে পোস্টার বানিয়ে ঘরের দেওয়ালে সেঁটে রাখা। আদ্যন্ত ব্রাজিল সাপোর্টার হয়েও শুধু ফোরলানের জন্য উরুগুয়ের সেমিফাইনাল হারে তীব্র কষ্ট পাওয়া। সেই ফাইনালে আবার জিওভান্নি ব্রঙ্কহর্স্ট লেফট মিড থেকে একটা গোল করেছিল আউটসাইড অফ দ্য ফুট থেকে। আর ফোরলান হাফভলিতে একটা গোল করেছিল জার্মানির বিরুদ্ধে থার্ড প্লেসের ম্যাচে— এই দুটো গোল, আজীবনের সঞ্চয়। আমরণ ভোলা সম্ভবই নয় ঐ গোলদুটো।
এত বিশ্বকাপ এল, আসবেও, কিন্তু ২০১০ অন্য কিছুই ছিল। আসলে বড় হওয়ার প্রথম ধাপের জোরালো কন্টিনিউটি ছিল ওটা। এমন একটা সময়, যখন আমরা মাধ্যমিক দেব আর বছর তিনেক পর। সেই সময় লম্বা চুলের মেসির সাথে একটা প্লেয়ারকে দেখলাম শুধু ঠোঁটের নিচে দাড়ি রাখে। স্পেনের ৭ নম্বর জার্সি, দাভিদ ভিয়া। ব্যস, দুম করে ভাল লেগে গেল। তারপর দেখলাম চিলির এগেন্সটে দূর থেকে শটে গোল। স্পাইক করা চুলে হাত ছড়িয়ে সেলিব্রেশন। সেই ‘স্পাইক’ শব্দটা নতুন করে চেনা। শাবালালার গোলের পরে আফ্রিকান ডান্স, স্লোভাকিয়ার অঘটন, অক্টোপাস পলের ভবিষ্যৎবাণী।
২০১০-এর মত এত প্রকট ছায়া আর কোনও বিশ্বকাপ ফেলতে পারেনি। স্কুলের প্রতিদিনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঐ বিশ্বকাপ। খাতায় নোট করে রাখা কে আজ ক’টা গোল করল, কে কততে জিতল, কারা খেলল। আনন্দমেলা থেকে প্লেয়ারদের ছবি কেটে ডায়রিতে আটকানোর সেই শুরু (যদিও এটা ২০০৬ থেকে কিছুটা)। বিশ্বকাপ সূচি আলমারির দেওয়ালে আটকে রাখা।
ফুটবলারদের কার্ড, জেতা-হারার ঊর্ধ্বে উঠে ২০১০ বিশ্বকাপ আসলে ভালবাসার আরেক নাম। একটা বিশ্বকাপ, গতানুগতিক স্কুল-পড়ার জীবনে হঠাৎ ধেয়ে আসা একটা আনন্দের আলোড়ন। ঐ কিসসার গল্প জীবনে ফুরোবে না। আসলে, কারোরই ছোটবেলার গল্প কোনও দিনও ফুরোবার নয়।
হোয়েন আই গেট ওল্ডার,
আই উইল বি স্ট্রংগার,
দে কল মি ফ্রিডম,
জাস্ট লাইক আ ওয়েভিন ফ্ল্যাগ…
ও হো হো হো হো!
কাল থেকে দ্বাবিংশতম বিশ্বকাপ শুরু। নিজের ভাল লাগার টিমকে অনেক সাপোর্ট করুক সবাই। কেউ জিতবে, কেউ হারবে, কেউ হেরেও এরিনা ছাড়ার আগে দুটো ভাল লাগার মুহূর্ত রেখে যাবে। বেড়ে ওঠার তারকাদের শেষ বিশ্বকাপে ওয়ান লাস্ট ডান্স, কেউ বলে যাবে আমরা আগামীর তারা হতে এসেছি। কেউ দু’হাত বাড়িয়ে বলবে, আমি তোমাদেরই লোক। আর সব কিছুর ওপরে উঠে বরাবরের মত জিতে যাবে ফুটবল। জয় ফুটবলের জয়!
এনজয় দ্য ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ।