ফার্স্ট থিং ফার্স্ট। তিতের মতো টেকনিকাল অ্যাবিলিটির কোচ সারা ভূব্রাজিলে নেই। যে দলটা হিসাব মতো ২০২৬-এ পিকে উঠত, তাকেই এ বছর অন্যতম ফেভারিট বানিয়ে ফেলা, যার তার কম্ম নয়। নেইমার এখন প্লেমেকার কাম গোলস্কোরার। সেই অর্থে ব্রাজিলের গোলস্কোরার কেউ নেই।
এই পরিস্থিতিতে যেভাবে রিচার্লিসনকে ব্যবহার করে নেইমারকে অপ্টিমাম কার্যকরী করে ফেলেছিলেন সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। ক্যাসিমেরোর ট্র্যান্সফরমেশনের জন্য অবশ্য এরিক টেন হাগের প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু থিয়েগো সিলভার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য তিতের ডিফেন্সিভ কোচেদের নম্বর দেওয়া উচিত।
এসব সরিয়ে এবার আসল খেলাটায় আসি। ক্রোয়েশিয়ার এই দলটি চার বছর আগের দলের তুলনায় কিছুই না। কারণ এই দলে একটা মারিও মান্দজুকিচ নেই, যিনি বক্সের যে কোনও জায়গা থেকে গোলে বল রাখতে পারবেন এবং আকাশেও সমান পারদর্শী। কিন্তু মাঝমাঠে এবার যুক্ত হয়েছে মার্সেলো ব্রোজোভিচের মতো একটা দুরন্ত বুনো ঘোড়া। যাঁকে শুরুতে মাঝমাঠের ঠিক মাঝখানে রেখে শুরু করেন জলাটকো দালিচ। নেয়মার তখন মাঝখান দিয়ে অপারেট করছেন।
তিতে ভেবেছিলেন যে ভিনি এবং রাফিনহার ওয়ান অন ওয়ানের সুপিরিয়র কোয়ালিটি দিয়ে বক্সে বা ঠিক বক্সের মাথায় সুযোগ সৃষ্টি করবেন। কিন্তু এইখানেই রাইটব্যাক জুরানোভিচ এবং লেফট ব্যাক সোসা দুর্দান্ত খেলে দেন ক্রোয়েশিয়ার। উভয়েই দুই উইঙ্গারকে এক পায়ে রাখতে শুরু করেন। আর ডিপ ডিফেন্সের ওভারলোডে ইনসাইড কাট করে গোলে শট রাখার জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হয় উইঙ্গারদের।
নেয়মারও এই সময় নিষ্প্রভ হয়েছিলেন, কারণ ব্রোজোভিচ নেইমারের সঙ্গে নিজেদের অর্ধে আঠার মতো লেগেছিলেন।
ব্রাজিলের বাঁদিকে ড্যানিলো উঠে এসে ইনভার্টেড ডিফেন্সিভ পিভট হিসাবে কাজ করছিলেন এবং ক্যাসিমেরোর সঙ্গে হাত ধরা দূরত্ব নিজেকে রাখছিলেন। মডরিচ উঠে এলেন, ক্যাসিমেরোর সাপ্লাই লাইন বন্ধ করতে আর একই সঙ্গে ড্যানিলোকে প্রেস করতে।
এর প্রতিকার হিসাবে তিতে ক্যাসিমেরোকে সামান্য তুলে দিলেন যাতে নেইমারকে বা পাকুয়েতাকে নিচে না নামতে হয়, কিন্তু ড্যানিলোর ডিস্ট্রিবিউশন সেই দরের না হওয়ায় ব্রাজিলের বিল্ডআপ বেশ ধীরগতির হতে লাগল এবং বারবার উইং-এ ধরা পড়ে যেতে লাগলেন ভিনি বা রাফা।
ব্যাপারটা বুঝে তিতে নামালেন অ্যান্টনি এবং রদ্রিগোকে। অনেকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন রদ্রিগো কেন? মার্টিনেলি নয় কেন! আসলে রদ্রিগো সরসরি ভিতরে ঢুকে নেয়মারের সঙ্গে লিঙ্কআপটা করতে পারবেন, অ্যান্টনিও সোজা সোসাকে ড্রিবল করে সরাসরি ভিতরে ঢুকছিলেন।
পাকেতা সামান্য নেমে পিভট হলে ডানদিকে মিলিতাও উঠে আসছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ডালিচ তাঁর হাতের পাঁচটা তাস একে একে ফেলতে শুরু করেছেন। এক, পাসালিচ ও ক্রামারিচকে বদলে ফ্রেস লেগস নামালেন ভ্লাসিচ আর ব্রুনো পেটকোভিচকে। দুই অ্যান্টনি বারবার সোসাকে ঝটকায় ফেলে দিচ্ছেন দেখে সোসাকে তুলে নামালেন অরসিচকে আর সঙ্গে লাগিয়ে দিলেন পেরিসিচকে, পেরিসিচ গিয়ে দুটো হাঁটুর নিচে মারতেই অ্যান্টনি উদ্দেশ্য ভুলে ভুলভুলাইয়ায় ঘুরতে শুরু করলেন।
গোলটা কিন্তু এভাবেই হত, নেয়মার প্রথমে রড্রিগোর সঙ্গে ওয়াল খেললেন, তারপর পাকুয়েতাকে। লিভাকোভিচ এতক্ষণ পর্যন্ত আউটিং-এ ব্রিলিয়ান্ট টাইমিং দেখাচ্ছিলেন। লিভাকোভিচকে দেখে আমার ফুল ফর্মের ন্যুয়ারের কথা মনে হচ্ছিল। আউটিং-এর পর ঠিক সময় একটা হাঁটু মাটিতে নামিয়ে দুই পায়ের ফাঁক বন্ধ করা, হাতটা ঠিক সময়ে তোলা। এইভাবে পাকেতা আর নেয়মারকে দু দুবার আটকে দিলেন তিনি। নেইমার গোলের বলটার সময় তাই শেষমেশ গোলকিপারকেই ড্রিবল করে একদম আপার নেটে মারলেন।
এরপরেই গণ্ডগোল শুরু হল। ড্যানিলো ক্লান্ত আর মিলিতাওয়ের ক্র্যাম্প। তিতে মিলিতাওকে তুললেন। ক্লান্ত ড্যানিলো ডানদিকে চলে এলেন। ফ্রেডকে নামালেন যাতে কাউন্টার প্রেস করতে পারেন। অ্যান্টনিকে নির্দেশ দিলেন ট্র্যাকব্যাক করতে।
কিন্তু আসল সময়ে দুজনেই ফলটার করলেন। আরও একটা ব্যাপার হল ক্রোয়েশিয়ার ফরোয়ার্ডলাইনের গতিকে অতিরিক্ত সমীহ করা। ক্যাসিমেরো এবং মার্কুইনহোস ফালতুই ব্রেক অ্যাওয়ে মুভকে চেন টেনে নামিয়ে দিতে গিয়ে কার্ড খেলেন।
ফলস্বরূপ যখন অ্যান্টনির কাছ থেকে পেরিসিচ বল কাড়লেন আর অরসিচ বল নিয়ে উঠলেন, ড্যানিলো তখন মানিকতলা মোড়ে, ফ্রেড আর অ্যান্টনি হামাগুড়ি দিচ্ছেন মানি স্কোয়ার মলে। বল যখন ভিতরে ঢুকল, ক্যাসিমেরো ফাউল করে আটকাতেই পারতেন, কিন্তু ততক্ষণে তিনি হলুদ কার্ডে রয়েছেন। কপাল খারাপ, একটা শট একটা ডিফ্লেকশন আর একটা গোল। ডিফ্লেকশন না হলে হয়তো এলিসন সুযোগটা পেতেন ফিস্ট করার।
সে যাক, একটা দল যার সম্ভাব্য গোল একেরও নিচে, যারা একটাই গোলে শট মারতে পেরেছে, তারা খেলাটাকে টেনে নিয়ে যেতই পেনাল্টি শ্যুটআউটে। আর তিতে টেকনিকালি স্ট্রং হলেও রিয়্যাকশন বা ম্যাচ রিডিং নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। কারণ ক্রোয়েশিয়ার বাম উইঙটা যত সচল ডান দিকটা নয়। সেক্ষেত্রে ড্যানিলোর থেকে যাওয়া আর মিলিতাওয়ের উঠে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন আসবেই।
তবে মডরিচ, গয়ারদিওল আর লভরেনের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। যেমন এটাও প্রশ্নযোগ্য ওই কেরিয়ার ডিফাইনিং গোলটা করার পর নেয়মার মাঠে কী করছিলেন? যদি তাঁকে তিতে তুলতে না পারেন, তাহলে নেয়মার বল হোল্ড করার দিকে গেলেন না কেন? ক্যাসিমেরো, সিলভার মতো নেতারাও খেলাটাকে ধীরে করলেন না কেন?
আসলে ব্রাজিলের গত কুড়ি বছর যাবত প্রচুর কেনর উপর টিকে আছে ফুটবল। ফ্রি ফ্লোইং ফুটবল ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে, ট্যাকটিকাল গেম তার জায়গা নিচ্ছে। সেই জায়গায় ব্রাজিল দলটার আলাদা দায়িত্ব ছিল, তারা নিজেদেরকে সেই যোগ্যও করে তুলেছিল, কিন্তু সঠিক সময়ে মানসিক কাঠিন্য ও পরিপক্কমনস্কতা না দেখাবার ফল ভুগল। পেনাল্টি শ্যুটআউটে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী নেয়মারকে আগে ব্যবহার করা যেত। তাহলে হয়তো পঞ্চম শটটা বাঁচাবার সুযোগ এলিসনের মতো বিশ্বমানের গোলকিপার পেতেন। সেটা হল না।
অথচ এবারের প্রসেসটা ভালো ছিল, ডিফেন্সিভ অ্যাপ্রোচ থেকে শুরু করে আক্রমণভাগের প্রতিটি খেলোয়াড়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যান। সেটা কার্যকর করা গেল না তার জন্য দায়ী, দালিচের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, মডরিচ, কোভাচিচ সহ পুরো ডিফেন্সিভ লাইনের লড়াই করার ক্ষমতা এবং অবশ্যই লিভাকোভিচ।
ব্রাজিল বা ইংল্যন্ডের পরিস্থিত বেলজিয়ামের মতো নয়। তাদের সাপ্লাই লাইন এখন বেশ ভালো অবস্থায়, কিন্তু এই জেনারেশনের খেলোয়াড়দের এইটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল, যে সুযোগটা হয়তো এর পর থিয়েগো সিলভা বা হেন্ডারসনরা পাবেন না। কিন্তু ফুটবল খেলাটা সম্ভাবনার বাইরেও অনেক কিছু সেটাই বোধহয় ক্রোয়েশিয়ার ডালিচ বা মরক্কোর রেগরাগুইরা দেখিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। যেমন যাচ্ছেন আর্জেন্টিনার স্কালোনি। লিমিটেড রিসোর্স নিয়ে কীভাবে সফল হতে হয়।