লিওনেল মেসি, অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু

সাল ২০১৬, মেটলাইফ স্টেডিয়াম, নিউ জার্সি। তিন বছরে আর্জেন্টিনার খেলা তৃতীয় ফাইনাল যেখানে মেসি নিজেই পেনাল্টি মিস করলেন। আর্জেন্টিনা টানা তিন ফাইনাল হারলো যার একটা ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল।

কারো একে হয় না,কারো একে না হলে দুয়ে হয়, কারো একে, দুয়ে না হলে তিনে অবশ্যই হয়। মেসির চারেও হলো না। বুম, কোলাপ্সড। সব শেষ। টিম আর্জেন্টিনা কোলাপ্সড। কোলাপ্স শুধু মাঠে নয়। সব জায়গায় সব কিছু শেষের পথে। বোর্ড তখন নাই, করাপশন এর জন্য ফিফা নালিফাই করে দিয়েছে।

বোর্ডের ফাইনান্স নেই, কোচের বেতন দেয় না, প্লেয়ারদের খাবার নিজেরা জোগাড় করে, বিমান ভাড়া দেয় না এমনকি সিকিউরিটি এর টাকা পর্যন্ত নাই। তার উপর টানা তিন ফাইনাল হার। এর উপর আরও অন্ধকার নেমে আসল মেসির ডিসিশনে। মেসি বলে দিল, ‘সম্ভবত ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল আমার জন্য না।’ ২০১৬, সেই ২০১৬।

পরবর্তী দুই বছর সিচুয়েশন আরো খারাপ হল। ১৬ থেকে ১৯ মেসি এবং আর্জেন্টিনার জন্য জঘন্যতম একটা টাইমলাইন। মেসি অবসর থেকে ফিরে আসলেও জাতীয় দলের পারফরম্যান্স জঘন্য থেকে জঘন্যতম। বাছাই পর্বে লাগাতার পয়েন্ট ড্রপ করতে করতে বাদ পরার মত অবস্থা। ইকুয়েডরের সাথে ইনহিউম্যান হ্যাটট্রিকে বিশ্বকাপ খেলা হলেও বিশ্বকাপে হিউমিলিয়েশন নিশ্চিত ছিল। ক্রোট দের সাথে লজ্জাজনক হারের পর ফার্স্ট রাউন্ডেই বিদায় থেকে রক্ষা হল ওই মেসির পায়েই।

এই সময় টা শুধু জাতীয় দলের জন্যই কি খারাপ ছিল? না। ২০১৬-২০ এই সময় মেসি তার ক্যারিয়ারের লোয়েস্ট পয়েন্ট দেখেছে।

এই সময়ে মেসির আর্ক রাইভাল ক্লাব এবং পার্সন টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতল, ব্যালন ডি অর পার্থক্য ৫-০ থেকে ৫-৪ হয়ে গেলো ১৮ এর আগেই। লাগাতার ক্লাবের হয়ে হিউমিলিয়েশন। জুভেন্তাস, রোমা, এনফিল্ড, লিসবন। ৩-০, ৪-০, ৮-২। একের পর এক হিউমিলিয়েশন। এভ্রিথিং ওয়াজ কোলাপ্সিং, সব কিছু নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। সব কিছু সব।

ব্যাক্তি লিও মেসি এই সময় সফল ছিলেন। প্রচণ্ড সফল। তুখোড় রিয়াল মাদ্রিদ যখন জিদানের হাতে থ্রি পিট জিতল সেই রিয়াল মেসির কাছেই টানা দুই লিগ হেরেছিল। মেসি রিয়াল রে লিগ দেয় নাই। এই সময় মেসি দুইটা গোল্ডেন বুট জিতছে। বিশেষ করে ১৯ এর লিও মেসির কোনো তুলনা নাই।

মেসির ক্যারিয়ারের সব থেকে ম্যাচিউর সিজন। অসাধারণ এই সিজনও শেষ হল ট্রাজেডি দিয়ে। এনফিল্ড ট্রাজেডি। সম্ভবত যে সিজন থেকে সব অন্ধকারের অবসান হওয়ার কথা ছিল সেই সিজনই সব শেষ করে দিচ্ছিল। এনফিল্ডের পর বার্সা আর দাঁড়াইতে পারে নাই, এখনো না।

১৯ যে রকম এনফিল্ড ট্রাজেডি দিয়েছিল, আরেকটা ব্যাপারও হয়েছিল। আর্জেন্টিনা টিমের রিডেম্পশন এর সুচনা।

২০১৯ এ ব্রাজিল এ যে কোপা হয়েছিল এই টুর্নামেন্ট পারফরম্যান্স এর ভিত্তিতে আমার দেখা জঘন্যতম এক টুর্নামেন্ট। কলম্বিয়ার কাছে হিউমিলিয়েশন, প্যারাগুয়ের সাথে হারতে হারতে ড্র। ইভেন এই দলটা কাতারের সাথেও স্ট্রাগল করছিল। এই দল সেমিতে ব্রাজিলের কাছে হেরে যায়। যদিও থার্ড প্লেস পায় আর্জেন্টিনা। কিন্ত ব্যাপারটা ওই থার্ড প্লেস থেকেও বেশি ছিল।

চিলি ম্যাচের শেষে মেসি পুরো টিমকে ডেকে একটা স্পিচ দিয়েছিল। ডি মারিয়া একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিল মেসির স্পিচে প্রত্যেকটা প্লেয়ার, বিশেষ করে জুনিয়াররা কেঁদে দিয়েছিল। তারা প্রচন্ড রকম অনুপ্রাণিত ছিল। এবং এইদিন থেকে আর্জেন্টিনার গ্রেট রানের সুচনা হল।

২০১৪ থেকে ২০২০, মেসির জন্য অনেক দুর্ঘটনা হয়েছে। কিন্ত এই সময় গুলো লিও মেসি কে প্রচন্ড রকম পরিনত করেছে। কয়লা পুড়ে ডায়মন্ড হয়, ডায়মন্ড পুড়ে কি হয় আমি জানি না। কিন্ত মানুষ পুরে মহামানব হয়। মেসি এই সময় গুলোতে নিজেকে অন্য পর্যায়ে পুশ করেছে যার কারন ছিল এতগুলো বার সফলতার কাছে গিয়ে ফিরে আসা।

মেসি ২০১৯ এর ব্যার্থতার পর টিমের ড্রেসিং রুমে যে মোমেন্টাম ক্রিয়েট করতে পেরেছিল, যে ওয়েদার ক্রিয়েট করতে পেরেছিল সেটা আর্জেন্টিনাকে ৩০ বছর পর অভিশাপ মুক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, দলটা চলে এসেছে বিগেস্ট গ্লোরির একদম দাড় প্রান্তে। এই যে মোটিভ, এই যে ফাইটের ইন্সপিরেশন, এই যে ইউনিটি, এই যে মেন্টালিটি এটা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে মেসিই।

শুধু কি অফ দা ফিল্ড? নো। মেসি তার বিগেস্ট এট্রিবিশন দেখায় ওই মাঠেই। কোপা আমেরিকা যে আর্জেন্টিনা জিতলো, মেসি শুধু মোটিভেশনাল জায়গা কভার করেই ক্ষান্ত হয় নাই। আর্জেন্টিনা যে ৩৫ ম্যাচ আনবিটেন ছিল,মেসি শুধু মোটিভেশনাল জায়গা কভার করেই ক্ষান্ত হয় নাই৷ আর্জেন্টিনা যে বিশ্বকাপের ফাইনালে এইখানেও মেসির কন্ট্রিবিউশান শুধু মোটিভেশন আর ক্যাপ্টেন্সি না। তার বিগেস্ট ফ্লেক্স তার পারফরম্যান্স।

কোপার হাইয়েস্ট গোল, অ্যাসিস্ট, গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বল সব তার। ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফায়ার এ দলের বেশি গোল, বেশি এসিস্ট সব তার। ওয়ার্ল্ড কাপের হাইয়েস্ট গোল, এসিস্ট তার।

ঠিক এজন্যই মেসিকে তার টিমমেটরা ঈশ্বরের ট্রিটমেন্ট দেয়। এই টিম শেষ হয়ে গিয়েছিল। কোলাপ্সড, বুম। কিচ্ছু নাই। কিছু না। একদম রুট থেকে, একদম ছাই থেকে একটা নতুন জেনারেশন কে কাঁধে করে তুলে আনার যে গল্পটা, এই গল্পটা অবিনশ্বর। বার বার গ্রেটনেসের জায়গা থেকে স্লিপ করে আবারও সেই গ্রেটনেসের দিকে মেসির যে যাত্রা, এই গল্পটা অবিনশ্বর। ফেলো কান্ট্রিমেন দের কাছে ভুল বোঝার স্বীকার হওয়া থেকে তাদের কাছে সর্বেসর্বা হওয়ার যে গল্পটা, সে গল্পটা অবিনশ্বর।

আমি জানি না ১৮ ডিসেম্বার লুসাইলে আমরা মেসিকে কিভাবে দেখব। তবে মেসি এই দলটা নিয়ে যে মহাকাব্যের জন্ম দিয়েছে তা ফুটবল জগতে সকল অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে যুগে যুগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link