শচীন ও মেসি, মিলেছেন মোহনায়

একদিকে ক্রিকেটের ঈশ্বর, অন্যদিকে ফুটবলের জাদুকর। একজন বাইশ গজে উইলো হাতে শাসন করেছে গোটা বিশ্ব, অন্যজন পায়ের জাদুতে গোল বলটাকে রীতিমতো কথা বলিয়েছেন। ক্যারিয়ারেও দুজনের মাঝে কি আশ্চর্য মিল, নিজেদের শেষ বিশ্বকাপে এসে মিলে গেছেন একই বিন্দুতে। শচীন টেন্ডুলকারের ন্যায় লিওনেল মেসিও কিনা বিশ্বজয়ের খেতাবটা পেলেন নিজের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ খেলতে এসে।

আর্জেন্টিনার ফুটবলে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মেক্সিকোকে বল পায়ে রীতিমতো জাদু দেখাচ্ছিলেন। অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে শিরোপা হাতে উল্লাস করেছিলেন, ব্যাটনটা তুলে দিয়েছিলেন পরের প্রজন্মের কাছে।

এর চার বছর আগেই কপিল দেব ভারতকে প্রথমবারের মত ক্রিকেটে পরিচয় এনে দিয়েছেন, ধুঁকতে থাকা এক দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে গণজোয়ার এনে দেন। এই দুই মহাতারকারই উত্তরসূরি লিওনেল মেসি এবং শচীন টেন্ডুলকার। 

দুজনে কাছাকাছি সময়ে দুটো ভিন্ন খেলায় রাজত্ব করেছেন। দুজনের বিশ্বকাপ জেতার আগেই সেরার তকমা পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই যেন বিশ্বকাপ ট্রফিটা ধরা দিচ্ছিল না। খুব কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে প্রতিবার।

শচীনের কথাই ধরা যাক, ক্যারিয়ারের শুরুতেই সুযোগ এসেছিল বিশ্বকাপটা নিজের করে নেয়ার। কিন্তু ২০০৩ বিশ্বকাপের সে আসরের ফাইনালে রিকি পন্টিংয়ের সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দাঁড়াতেই পারেনি সৌরভ গাঙ্গুলির ভারত।

অন্যদিকে, ২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবলে ফাইনাল জেতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন লিওনেল মেসিও। কিন্তু জার্মানির বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে মারিও গোটজের গোলে স্বপ্নভঙ্গ হয় তাঁদের। এরপর সময় যত গড়িয়েছে দুই মহাতারকার শিরোপার আক্ষেপ তত তীব্র হয়েছে।

শচীন রানের পর রান করেছেন। ব্যাট হাতে শাসন করেছে বিধ্বংসী সব বোলারদের। উইকেটের চারপাশে অসাধারণ সব শটের পসরা সাজিয়ে মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের। অন্যদিকে বার্সেলোনার হয়ে ক্লাব ফুটবল সম্ভাব্য সকল ট্রফিই জিতেছেন মেসি।

সবুজ গালিচায় তাঁর বিচরণ সাবলীল, পায়ের জাদুতে পরাস্ত করেছে কতশত ডিফেন্ডার-গোলকিপারদের। কিন্তু তাতেও যেন কিছু হচ্ছিল না, অমরত্ব প্রাপ্তির পথে তাঁদের একমাত্র বাঁধা ছিল বিশ্বকাপ। স্বর্গ থেকে বিধাতা নিশ্চিতভাবেই মুচকি হাসছিলেন, সবকিছু তিনি জমিয়ে রেখেছিলেন শেষের জন্যই।

২০১১ সালে ঘরের মাঠে নিজের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে নামেন শচীন টেন্ডুলকার। সেই বিশ্বকাপেই মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃতে ২৭ বছর পর বিশ্বকাপ জেতে ভারত। প্রথমবারের মত বিশ্বজয়ের স্বাদ পান শচীন, অমরত্বপ্রাপ্তির পথে আর কোনো বাঁধাই যেন টিকলো না। শচীনের তবু হল, কিন্তু মেসি! ২০১৪ বিশ্বকাপের দুঃখ ছাপিয়ে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় দ্বিতীয় রাউন্ডেই। বাক্যবাণে, দুঃখে মেসি কাতার বিশ্বকাপের আগেই জানিয়ে দিলেন এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ।

অথচ শেষ বিশ্বকাপের শুরুটাই কিনা হার দিয়ে! প্রথম ম্যাচেই আনকোরা সৌদি আরবের কাছে হেরে গোটা বিশ্বকাপটাই শংকায় আর্জেন্টিনার। বড় তারকারা বড় মঞ্চেই জ্বলে ওঠেন, গ্রুপর্ব থেকে শুরু করে সেমিফাইনাল পর্যন্ত প্রতি ম্যাচে গোল করে দলকে তুললেন ফাইনালে।

প্রতিপক্ষ ফ্রান্স, চার বছর আগে দু:খের সাগরে ভাসানো দিদিয়ের দেশমের বিশ্বজয়ী দল। শচীনের যেমন ছিলেন ধোনি, তেমনি মেসির ছিলেন এমিলিয়ানো দিবু মার্টিনেজ। ধোনি যেমন ফাইনাল জেতানোর দায়িত্বটা তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে, দিবুও তাই। মেসির জোড়া গোলের পরও এমবাপ্পের হ্যাটট্রিকে আরও বিশ্বকাপ হারের শংকা জেঁকে বসেছিল মেসিকে। কিন্তু টাইব্রেকারে চীনের প্রাচীর গড়ে তোলে মেসিকে সেই বৈতরণী পার করান দিবু, প্রথমবারের মত বিশ্বজয়ের স্বাদ পান মেসি। 

লুসাইলের ফাইনালের পর শচীন এবং মেসি দুজনেই যেন মিলে গেলেন একই বিন্দুতে এসে। দুজনের মাঝে আরেকটা মিলও আছে। দুজনের জার্সি নাম্বারই ১০!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link