উত্থান থেকে পতন, স্ট্রাগল, প্রত্যাবর্তন – এবং সবশেষে অভিমানে নিভৃতে সরে যাওয়া। কোনো থ্রিলার সিনেমার থেকে কম কিসে?
মাত্র ১৭ বছর বয়সে লর্ডসে অভিষেক, পাকিস্তানের ভাগ্যের কোল আলো করে আসা মোহাম্মদ আমির প্রথম বছরেই পেয়ে যেতেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ট্রফি। ২০১০ সালের লর্ডস টেস্টে সেদিন ৮৪ রানে ৬ উইকেট নিয়ে নিজের নাম ‘অনার্স বোর্ডে’ তুলেছিলেন সে সময়ের ১৮ বছর বয়সী আমির।
কিন্তু, এমন কীর্তি ঢাকা পড়ে গেল স্পট ফিক্সিংয়ের কালো ছায়ায়। জানা গেল এমন বোলিং-কীর্তির মধ্যেও জুয়াড়িদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমির ইচ্ছাকৃত ‘নো বল’ করেছেন কয়েকবার। নাটকটা যদিও সে সময়ের অধিনায়ক সালমান বাটের নির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয়েছিল, কিন্তু তাতে যোগসাজশের কারণে বাটের সঙ্গে ফেঁসেছিলেন আমির ও মোহাম্মদ আসিফ।
খুব সম্ভবত সেই সময়টার কথা মনে করলে আজও আতঙ্কে নীল হয়ে যান আমির। নায়ক থেকে হঠাৎই খলনায়ক। নির্বাসিত জীবন। কী যন্ত্রণা, খুব অল্প বয়সেই আমির সেটা বুঝে গিয়েছিলেন। ক্রিকেট থেকে পাঁচ বছরের জন্য কেবল নিষিদ্ধই হলেন না, ইংল্যান্ডের তরুণ অপরাধীদের সংশোধনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি ইনস্টিটিউটে তিন মাস বন্দিজীবনও কাটালেন। লোভের ফাঁদে পড়ে অন্ধকার জীবনের তলানিতেই যেন পৌঁছে যাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে।
তবে আশা ছাড়েননি আমির।
বনবাস থেকে ফিরে পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেট খেললেন, পারফর্ম করলেন। এরপর ডাক আসলো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল)। সেখানে দারুণ পারফর্ম করে ফিরলেন জাতীয় দলে। জাতীয় দলের হয়ে ফেরার শুরুটাও ছিল কাঁটায় ভরা। তাকে ডাকার প্রতিবাদে ক্যাম্প বর্জন করেন দুই সিনিয়র ক্রিকেটার মোহাম্মদ হাফিজ ও আজহার আলী। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) অনেক দরকষাকষি করে তাদের এক সাথে খেলতে রাজি করায়।
২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে ভারতের টপ অর্ডারে ধস নামানো মোহাম্মদ আমিরের সেই স্পেলের কথা মনে আছে? মাত্র ১৬ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ভারতীয়দের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন একাই, পাকিস্তান সেবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা জিতেছিল প্রথমবারের মতো। যার জন্য হাফিজ-আজহাররা ক্যাম্প ছেড়েছিলেন – সেই আমিরের জাদুতেই ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় অর্জনের মুখ দেখেন তাঁরা।
চ্যাম্পিয়ন ট্রফির ফাইনালের পর অনেকটা নিজেকে হারিয়ে ফেলেন আমির। মাঝের এ সময়ে আমির যে খুব খারাপ বোলিং করেছিলেন তা নয়। এ সময়ে তার ইকোনমি রেট ছিল ৪.৫৮। কিন্তু আমিরকে যে লোকে শুধু কিপটে বোলিংয়ের জন্য চায় না, তার কাছে দলের মূল চাওয়া হচ্ছে উইকেট, সেখানেই হালে পানি পাচ্ছিলেন না।
বিশ্বকাপে তার প্রথম ম্যাচের আগে ১৪ টি ওয়ানডেতে উইকেটসংখ্যা ছিল ৫। ফলাফল বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলেই সুযোগ পাননি মোহাম্মদ আমির। শেষে জুনায়েদ খানের কপাল পুড়িয়ে দলে ফিরলেন। নিয়েছেন ১৭ উইকেট। তিনি বড় মঞ্চের নায়ক, ঠিক যেমন ক্রাইম থ্রিলার ছবিতে দেখা যায় – জয় হয় নায়কের।
মোহাম্মদ আমিরের গল্প এক দশকের গল্প, যে গল্পের অর্ধেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল ফিক্সিং নামক থাবায়, অতলে! পাকিস্তানের হয়ে ৩৬ টেস্ট, ৬১ ওয়ানডে ও ৫০ টি-টোয়েন্টি খেলা আমিরের আন্তর্জাতিক উইকেট সংখ্যা ২৫৯।
ছিলেন পাকিস্তানের ড্রেসিংরুমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হঠাৎ কী হলো যে মোহাম্মদ আমিরের জায়গা হচ্ছে না পয়ত্রিশ জনের দলেও?
টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে গিয়েছিলেন আরো আগেই । এ নিয়ে আলোচনা- সমালোচনাও হয়েছিল বিস্তর। খেলেছেন সর্বশেষ লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ (এলপিএল)। এলপিএল শেষে দেশে ফেরার আগেই এবার সবাইকে চমকে দিয়েছেন আমির। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব সংস্করণ থেকেই অবসর নিয়েছেন ২৯ বছর বয়সী এই পেসার।
পিসিবির অসহযোগিতাই মোহাম্মদ আমিরকে বাধ্য করেছে অবসর নিতে, এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘আমি ক্রিকেট ছাড়ছি। আমি মানসিক ভাবে নির্যাতিত। আমি মনে করি, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল অবধি যে নির্যাতন সহ্য করেছি, তা আর করতে পারবো না। আমার টেস্ট ছাড়ার সিদ্ধান্তকে ভুল ভাবে নেওয়া হয়েছে। টেস্ট ছাড়াকে টি-টোয়েন্টি লিগ খেলার আকাঙ্ক্ষা হিসেবে দেখা হয়েছে। আমার ইচ্ছা ছিল ক্যারিয়ারের বাকি সময়টা পাকিস্তানের সাদা বলের ক্রিকেটে বিনিয়োগ করবো। তবে, একেক সময় একেক জন একেক রকমের কথা নিয়ে হাজির হচ্ছেন। আমাদের বোলিং কোচ এসে বললেন, আমি নাকি কথা শুনি না। কেউ একজন বললো, আমি নাকি কাজের চাপ নিতে পারি না!’
তাই মোহাম্মদ আমিরকে নিয়ে কখনো কোনো বায়োপিক হলে সেটা হয়তো হতো আস্ত একটা থ্রিলার। কী নেই সেখানে? কে জানে, থ্রিলার ছবির শেষটা হয়তো দেখা এখনো বাকি!