২০১২ সালে সিডনিতে মাইকেল ক্লার্ক যখন মার্ক টেলরের ৩৩৪* ও স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪ রানকে ছাপিয়ে যাওয়ার দোরগোড়ায় এমনকি ম্যাথু হেইডেনের ৩৮০ কিংবা লারার কোয়াড্রপল সেঞ্চুরির রেকর্ডটাও ভাঙার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেন, তখন অধিনায়ক হিসেবে তিনি নিজেই উইকেটে দাঁড়িয়ে ইনিংস ঘোষণা করে দেন।
৩২৯ রানে অপরাজিত থাকার পরেও ইনিংস ঘোষণা করার সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গে ক্লার্ক বলেন, ‘আমি মনে করি, দল হচ্ছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে এবং আমরা দলের জন্যই খেলি। দলের জয় দেখতেই আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। এটা অধিনায়ক হিসেবে তো বটেই, খেলোয়াড় হিসেবেও। যদি ব্যাট করে যাওয়াটা দলের জন্য ভালো হতো, তবে আমি ব্যাটিংটা চালিয়েই যেতাম।’
সেদিন ক্লার্ক এমন একটা সময় ইনিংস ঘোষণা করেন যখন তাঁর দলের লিড ৪৬৮ রান এবং ম্যাচে সাড়ে সাত সেশনের মতো খেলা বাকি। এমতাবস্থায় চাইলেই তিনি মার্ক টেলরের রেকর্ডটা তাড়া করতে পারতেন। হতে পারতেন তখনকার লাল বলের ক্রিকেটে এক ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। হাতে যে পর্যাপ্ত সময় ছিল না, এমনটাও নয়।
এমনকি ম্যাচের ফলাফল দেখলে আপনি আফসোসের সুরে বলে ওঠতেই পারেন, ‘ইশ! কত সময় ছিল! চাইলে তো ক্লার্ক টেস্টে এক ইনিংসে লারার সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাও তাড়া করতে পারতেন!’ কারণ সিডনি টেস্টটা অস্ট্রেলিয়া ইনিংস ব্যবধানে জিতে নিয়েছিল গোটা একদিন হাতে রেখেই। কিন্তু ওই যে দলের জন্য খেলা, ফলাফলের পেছনে ছোটা; সেজন্যই আর কোনো ঝুঁকি নেননি ক্লার্ক।
আজ দীর্ঘ এগারো বছর বাদে সেই সিডনিতেই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটে আবারো সে রকমই একটা ঘটনা ঘটল। বিগত একবছর ধরে টেস্টে দারুণ ছন্দে থাকা ওপেনার উসমান খাওয়াজা নিজের প্রথম দ্বিশতক থেকে মাত্র ৫ রান দূরে থাকার সময় ইনিংস ঘোষণা করে বসেন অধিনায়ক প্যাট কামিন্স।
এটা অবশ্য কামিন্সের একার সিদ্ধান্ত নয়। এটা অধিনায়ক, কোচ তথা পুরো টিম ম্যানেজমেন্টেরই সিদ্ধান্ত। যদিও চাইলেই খাওয়াজাকে ২-৩ ওভার ব্যাটিংয়ের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তাঁকে দ্বিশতক হাঁকানোর সুযোগটা করে দিতে পারত টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু সেটা হয়নি। এখানেও এগারো বছর আগের মাইকেল ক্লার্কের সেই স্পিরিটটা কাজ করেছে। শুধু মাইকেল ক্লার্ক কেন, এটা যেন যুগ যুগ ধরেই পুরো অস্ট্রেলিয়ান টিম স্পিরিটেরই একটা প্রতিচ্ছবি।
অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার চলমান বৃষ্টিবিঘ্নিত সিডনি টেস্টের চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর আগ পর্যন্ত মাঠে বল গড়িয়েছে মাত্র ১৩১ ওভার, ব্যাট করেছে কেবল একটা দল। প্রথম ইনিংসে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ৪ উইকেট হারিয়ে ৪৭৫ রান সংগ্রহ করে যেখানে খাওয়াজা অপরাজিত থাকেন ১৯৫ রানে। কিন্তু তৃতীয় দিন পুরোটা বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ায় এবং চতুর্থ দিনের শুরুতেও বৃষ্টির বাধা থাকায় আর ঝুঁকি নেয়নি প্যাট কামিন্সের দল। ফলাফলপ্রত্যাশী অস্ট্রেলিয়া ইনিংস ঘোষণা করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানায়।
এদিকে এ সিরিজটাও স্বাগতিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলতি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের পথে ঝুঁকিমুক্ত থাকতে সিরিজের প্রতিটা ম্যাচকেই পাখির চোখ করেছে অস্ট্রেলিয়া। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় ম্যাচে যতটা সম্ভব ফলাফলের সম্ভাবনা তৈরি করা যায়, সে নীতিতেই হেঁটেছেন তাঁরা।
এখন প্রশ্ন হলো, খাওয়াজাকে কি ২-৩টা ওভারও সুযোগ দেওয়া যেত না?
চাইলে অবশ্যই যেত। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরা আর একটুও হেলায় সময় হারাতে চাননি। দেখা গেল, অস্ট্রেলিয়া চতুর্থ দিনে ব্যাটিংয়ে নামল, কয়েকমিনিটের মধ্যে খাওয়াজার দ্বিশতক পূর্ণ হলো এবং ইনিংস ঘোষণা করল, তখন আবার দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস শুরু করার আগে অন্তত ১০ মিনিটের মতো অতিরিক্ত সময় খোয়ানো যেত।
এদিকে আবহাওয়ার অবস্থাও আশাব্যঞ্জক নয়। সব মিলিয়েই তাই শুধু একজনের জন্য ব্যাটিংয়ে আর কোনো সময় ‘অপচয়’ করতে চায়নি অস্ট্রেলিয়া। কেননা অস্ট্রেলিয়ানরা তো বরাবরই এমন। তাঁদের কাছে ইন্ডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্সের চেয়ে দলের ফলাফলটাই যে মুখ্য!