সুরিয়াকুমার ব্র্যাডম্যান

২০২২ সালটা খুব একটা ভাল কাটেনি ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য। এশিয়া কাপ এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে তাঁরা বিদায় নিয়েছে ফাইনালের আগেই। সিনিয়র ক্রিকেটাররা ফর্মে ছিলেন না, ক্রমাগত ইনজুরি ভুগিয়েছে বছর জুড়েই। একমাত্র আশার আলো হল নতুন কয়েকজন তারকার আবির্ভাব ঘটেছে ভারতীয় ক্রিকেটে। সেই তারকাদের মাঝে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হলেন সুরিয়া কুমার যাদব। 

সুরিয়াকে ঠিক তরুণদের কাতারে ফেলা যাবে না। ৩২ বছর বয়সী এই ব্যাটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছেন ত্রিশ পেরিয়ে। আবির্ভাবেই জোফরা আর্চারকে ছক্কা হাঁকিয়ে জানান দিয়েছিলেন বাইশ গজে রাজত্ব করতেই তাঁর আগমণ। সেটা ছিল কেবলই শুরু। ২০২২ সালটা ছিল সুরিয়াময় এক বছর, নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। 

বছর জুড়েই রান করে গেছেন নিয়মিত বিরতিতে। পুরো বছরে ৪৬.৬ গড় আর অবিশ্বাস্য ১৮৭.৪ স্ট্রাইকরেটে তাঁর সংগ্রহ ১১৬৪ রান। তাঁর মতো গড় আর স্ট্রাইকরেট বজায় রেখে টি-টোয়েন্টি ইতিহাসেই ব্যাট করতে পারেননি কেউ। টি-টোয়েন্টির ধর্মটাই এমন – স্ট্রাইকরেট বাড়ালে গেলে গড় কমতে বাধ্য কিংবা অ্যাঙ্করের ভূমিকায় খেললে স্ট্রাইকরেট কমবেই। বিশ্বের অধিকাংশ ব্যাটারই এই অমোঘ নিয়ম মেনেই টি টোয়েন্টিটা খেলেন। 

কিন্তু সুরিয়া বাকি সবার চাইতে আলাদা। দুশো ছুঁইছুঁই স্ট্রাইকরেট আর পঞ্চাশের কাছাকাছি গড় কেবল তাঁর কাছেই পাওয়া সম্ভব। মোহাম্মদ রিজওয়ান তাঁর চাইতে বেশি রান করলেও স্ট্রাইকরেটে বেস পিছিয়ে। ২০২২ সালে রিজওয়ান ১৩২৬ রান করলেও তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৩৪.৯। তাছাড়া রিজওয়ান যেখানে পাওয়ার প্লে’তে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পান সুরিয়াকে সেখানে ব্যাট করতে হয় মিডল ওভার কিংবা ডেথ ওভারগুলোতে। তাছাড়া উপরের দিকে ব্যাট করেন বলে ইনিংস বড় করার সুযোগটাও বেশি পান রিজওয়ান।

টি টোয়েন্টি ইতিহাসে বছরে পাঁচশো’র অধিক রান করার ঘটনা ঘটেছে ৫০ বার। এর মাঝে কেবল দুজন ব্যাটার সুরিয়ার আশেপাশে আসতে পেরেছেন। ২০১৮ সালে অ্যারন ফিঞ্চ ৪০ গড় এবং ১৭৬ স্ট্রাইকরেটে ৫৩১ রান সংগ্রহ করেন এবং কলিন মুনরো ৪৫.৫ গড় এবং ১৭৮ স্ট্রাইকরেটে করেন ৫০০ রান। দুজনেই গড় আর স্ট্রাইকরেটে কাছাকাছি থাকলেও রানসংখ্যায় ছিলেন যোজন যোজন পিছিয়ে। 

মিডল অর্ডারে খেলার দরুণ সুরিয়াকে বেশিরভাগ সময় দারুণ সব স্পিনারদের সামলাতে দেখা যায়। চার কিংবা তাঁর চেয়ে নিচে ব্যাট করতে নেমে সুরিয়ার সংগ্রহ ৮৯৯ রান। মাঝের ওভারগুলোতে ফিল্ডাররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় স্পিনারদের বিপক্ষে বাউন্ডারি হাঁকানো বেশ কঠিন কাজ।

সুরিয়া সেই কঠিন কাজটাও করেন অবলীলায়, প্রতি ৪.২ বলে একটি করে বাউন্ডারি মেরেছেন এই ব্যাটার। ৫৫ চার এবং ৩৪ ছক্কা মিলিয়ে বছরজুড়ে তাঁর মোট বাউন্ডারি সংখ্যা ৮৯। মাত্র দুজন ব্যাটার পঞ্চাশের অধিক বাউন্ডারি মারতে পেরেছেন বছরজুড়ে। সিকান্দার রাজার ৫৫ বাউন্ডারির বিপরীতে কিউই ব্যাটার গ্লেন ফিলিপসের বাউন্ডারি সংখ্যা ৫৪টি। এদের মাঝে সিকান্দার প্রতি ৬.৩ বলে একটি করে বাউন্ডারি মেরেছেন। ফিলিপস খানিকটা উন্নতি করেছেন তাঁর চেয়ে, তাঁর বাউন্ডারি মারার হার ৫.৭ বলপ্রতি। 

তর্ক হতে পারে সুরিয়া তাঁদের চাইতে বেশি ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু বেশিন ম্যাচ খেললেও তিনি ঠিকই বলপ্রতি বাউন্ডারি হাঁকানোর হার ঠিকই ধরে রেখেছেন। স্পিনের বিপক্ষে তাঁর ১৫৭.৮ স্ট্রাইকরেট দুইশো কিংবা তাঁর অধিক রান করা ব্যাটারদের মাঝে সর্বোচ্চ। 

উইকেটের চারপাশে শট খেলতে দক্ষ সুরিয়াকে ইতোমধ্যেই ডাকা হচ্ছে ৩৬০ ডিগ্রী ক্রিকেটার। ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে মাঠের যেকোনো অংশে বল পাঠাতে তিনি সিদ্ধহস্ত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় স্পিনাদের বিপক্ষে স্কয়ারে অফ দ্য উইকেটেই বেশি রান করেছেন তিনি। এর কারণও আছে বলের গতি যত কমে যায়, ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে বাউন্ডারি হাঁকানো তত কঠিন হয়ে য্যা। সে কারণেই স্কয়ার অফ স্য উইকেটে চার বের করে নেয়া সহজ। তবে চিরায়তভাবেই তাঁর বেশিরভাগ ছয়’ই এসেছে মিড উইকেটের উপর দিয়ে।

তবে সুরিয়া সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর রূপ ধারণ করে ইনিংসের শেষের দিকে। ডেথ ওভারে ২৬০.৯ স্ট্রাইকরেটে তাঁর সংগ্রহ ৩৬০ রান। কমপক্ষে ১০০ বল মোকাবিলা করেছেন এমন ব্যাটারদের মাঝে তাঁর স্ট্রাইকরেটই সর্বোচ্চ। এছাড়া এই সময়ে প্রতি ২.৩ বলে একটি করে বাউন্ডারি মেরেছেন তিনি। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিকান্দার রাজার ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৩.৪। 

ডেথ ওভারে বোলারদের মূল অস্ত্র ইয়র্কার সামলাতেও দারুণ পটু সুরিয়া। এই বছরে ১৩টি ইয়র্কার মোকাবেলা করেও তাঁর স্ট্রাইকরেট আকাশছোঁয়া, ২৯২.৩! এর মাঝে আউট হননি একবারও। 

মাঠটাকে যেন অভিজ্ঞ প্রফেসরের মতো মাথায় গেঁথে নেন সুরিয়া। ফিল্ডারের অবস্থান বুঝে বলটাকে শিল্পীর ছোঁয়ায় পাঠিয়ে দেন সীমানার ওপারে। তাঁর ফুটওয়ার্ক, হাত ও কব্জির সম্মিলন, টাইমিং এবং দুর্দান্ত প্লেসমেন্ট জানান দেয় অপরিসীম দক্ষতার। অন্যথায় এমসিসিতে ওয়াইড ইয়র্কারকে কি করে ফাইন লেগের উপর দিয়ে গ্যালারিতে পাঠালেন তিনি!

রিচার্ড গ্লিসনকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন না, ক্যারিয়ারের প্রথম টি টোয়েন্টি সেঞ্চুরির পথে ইংলিশ এই বোলারের ফুল লেংথের ডেলিভারি শর্ট থার্ডম্যানের উপর দিয়ে পাঠিয়েছিলেন সীমানার বাইরে। অথচ এই লেংথের বলগুলো সাধারণত ডাউন দ্য উইকেটেই খেলতে পছন্দ করেন ব্যাটাররা। সুরিয়া থার্ডম্যানে খেলেছেন স্রেফ ফিল্ডার ত্রিশ গজের ভেতরে ছিলেন বিধায়। 

প্রতিটা বলের জন্য একাধিক পরিকল্পনা থাকে তাঁর। কখনো গুড লেংথের বল কিপারের মাথার উপর দিয়ে প্যাডল সুইপ করেন, আবার কখনো শর্ট লেংথ ডেলিভারি পুল করেন বোলারের মাথার উপর দিয়ে। একবার ম্যাচ শেষে বলেছিলেন, “আমি কখনো শক্তি দিয়ে শট খেলি না, কেবল ফিল্ডারের অবস্থান বুঝে খেলার চেষ্টা করি।” 

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর ১১১ রানের ইনিংসকে বিরাট কোহলি আখ্যায়িত করেছিলেন ভিডিও গেমস ইনিংস নামে। কোহলি সেই ম্যাচের একটা বলও সরাসরি দেখেননি, তবে বলাই বাহুল্য তাঁর সেই নামকরণে কোনো ভুল ছিল না। খেলার ধরণে মিল থাকায় সুরিয়াকে তুলনা করা হচ্ছে প্রোটিয়া কিংবদন্তি এবি ডি ভিলিয়ার্সের সাথে। 

টপ অর্ডারের ভালো সূচনাকে অপ্রতিরোধ্য বানিয়েছেন। টপ অর্ডার ব্যর্থ হলে লড়াকু সংগ্রহ এনে দিয়েছেন। এশিয়ার স্লো পিচে রান করেছেন। নিউজিল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বাউন্সি পিচে সেঞ্চুরি করেছেন। একজন ব্যাটসম্যানের পক্ষে সুরিয়ার ২০২২ সালকে ছাপিয়ে যাওয়া বোধহয় কখনোই সম্ভব না। তবে আপনি কট্টর সমালোচক হলে বলতে পারেন টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তিনি মাত্র ১৪ রান করে আউট হন। অথচ সেই টুর্নামেন্টেও ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন সুরিয়াকুমার যাদব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link