গল্লটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ভারতের টেস্ট সিরিজের; সময়টা ১৯৫৮-১৯৫৯।
পাঁচ টেস্টের সেই বিপর্যয়ের টেস্টে ভারতের অধিনায়কত্বের ব্যাটন সামলেছিল চারজন – পলি উমরিগার, গোলাম আহমেদ, ভিনু মানকাড়, হেমু অধিকারী! তবে এতেও সাধ মেটেনি ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের। পরের দুটো টেস্টেও ভিন্ন দুইজন টস করতে নামলে দেখা যায়- সাত টেস্টে ভারতের অধিনায়ক হয়েছেন মোট ৬ জন!
- প্রথম টেস্ট- বোম্বে
অধিনায়ক বদলের এই মিউজিক্যাল চেয়ারটা শুরু হয় আসলে সিরিজ শুরুর আগেই। তৎকালীন প্রধান নির্বাচক লালা অমরনাথ বারবারই চাইছিলেন গোলাম আহমেদকে অধিনায়কত্ব দিতে। তবে লালা অমরনাথ চাইলে কি হবে, অন্য দুই নির্বাচকেরা কিন্তু তা চাইছিলেন না। তাদের প্রথম পছন্দ গোলাম আহমেদ ছিলেন না।
এখানেও সমস্যা ছিল না, কিন্তু পরে দেখা গেল হায়দ্রাবাদি এই স্পিনারকে সমর্থকেরাও মেনে নিতে পারছেনা। আর এর মধ্যেই ইনজুরি বাঁধিয়ে বসেন গোলাম।
এতে লালা অমরনাথকে পিছু হাটতে হয়, নির্বাচক প্যানেলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মতে পলি উমরিগারকে দেওয়া হয় অধিনায়কত্বের টেস্টক্যাপ। তবে সে টেস্টে আরো তিনজনকে অভিষেক টেস্ট ক্যাপ পরিয়ে দেয় ভারত- চাঁদু বোর্দে, মনোহর হারদিকার, গোলাম গার্ড। ভারত সে টেস্ট ড্র করে।
- দ্বিতীয় টেস্ট- কানপুর
কানপুর টেস্টে গোলাম আহমেদ যখন দলে ফিরে আসল, কোন রকম সন্দেহ ছাড়া গোলাম আহমেদকে আবার অধিনায়কত্ব দেওয়া হল। লালা অমরনাথই বারবার চাইছিলেন আহমেদকে অধিনায়কত্ব দিতে। তা অধিনায়ক হিসেবে শুরুটা মন্দ হয়নি গোলাম আহমেদের, প্রথম দিনেই যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৮৮ রানে ৬ উইকেট পড়ে যায়। তবে সুখস্মৃতি ঐ পর্যন্তই। প্রথম ইনিংসে তো ২২২ করেই; ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৪৩ রানেই ইনিংস ঘোষনা করে দেয়।
তবে এ ম্যাচেই চতুর্থ দিনে হঠাৎ দর্শকেরা উত্তপ্ত হয়ে যায়। সেই মাত্রা এতই বেশি ছিল যে খেলোয়াড়দের পুলিশ পাহারায় হোটেলে নিয়ে আসা হয়।
- তৃতীয় টেস্ট- কলকাতা
কলকাতা টেস্টটা সবচাইতে সুখস্মৃতি হতে পারত ভারতীয়দের, কিন্তু তা হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজের রোহান কানহাই এর কল্যাণে । ভারতীয় বোলিং লাইনআপকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে তিনি করেন ২৫৬ রান। ভারতও সে টেস্ট হেরে যায়। পরপর দুই টেস্টে হেরে গোলাম আহমেদ অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন নিজ ইচ্ছায়।
- চতুর্থ টেস্ট- মাদ্রাজ
নাটকটা শুরু হয় এরপরই, চতুর্থ টেস্টের আগেই। গোলাম আহমেদ যখন অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেন, নির্বাচক প্যানেল দ্রুত এক বৈঠক ডাকে। সেই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন অধিনায়ক নির্বাচন করা।
লালা অমরনাথ তখন আবার ফিরে যান গোলাম আহমেদের কাছে। আবার অধিনায়কত্ব তুলে নিতে অনুরোধ করেন। তা গোলাম তাতে রাজিও হন।
নাটক এটুকুতেই শেষ হতে পারত। গোলাম আহমেদই মাদ্রাজে টস করতে নামতে পারতেন। কিন্তু টেস্ট শুরুর মাত্র চারদিন আগে গোলাম আহমেদ টেস্ট থেকেই অবসরের ঘোষণা দেন। নির্বাচক প্যানেল তখন আরো সমস্যায় পড়ে। প্রথমত তাদের একজন অধিনায়ক নির্বাচন করতে হবে। দ্বিতীয়ত গোলামের বদলী হিসেবে তার মানের একজন স্পিনার নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচক প্যানেলের মাথায় যখন চিন্তার ভাঁজ, ঠিক তখনই ব্যাটসম্যান বিজয় মাঞ্জেরকার নিজেকে আনফিট আখ্যা করে মাদ্রাজ টেস্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।
যা হোক, লালা অমরনাথ চাইছিলেন গোলামের জায়গায় পলি উমরিগারকে আবার অধিনায়কত্ব দিতে এবং স্পিনার হিসেবে জাসু পাটেলকে দলে নিতে। এই সমাধানটাই ছিল তখন সবচাইতে গ্রহণযোগ্য, তবে তাতে বাধ সাধেন উমরিগার নিজে। তিনি বলে বসেন, জাসু পাটেলকে নিলে তিনি অধিনায়কত্ব করতে রাজি নন।
সমস্যা যখন আরো জটিল হয়ে যাচ্ছে, তখন এই নাটকে যোগ দেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট । তিনি নিজে তখন জাসু পাটেলকে দলে চাইলেন। তা বোর্ড প্রেসিডেন্টকে উপেক্ষা তো কেউ করতে পারে না। পারেননি কেউই। উমরিগার এর মধ্যে যে কাজটা করলেন, তিনি অধিনায়কত্ব নিলেন, রিসিপশনে ম্যাচের আগে অধিনায়ক হিসেবে কথাও বললেন। আর হোটেলে ফিরে পদত্যাগ করলেন!
নির্বাচকেরা আবার ছুটে গেলেন উমরিগারের দরজায়। উমরিগার নির্বাচকদের সামনেই কেঁদে ফেললেন আর অধিনায়কত্ব নিতে অস্বীকার করলেন।
আর ম্যাচ শুরুর ঠিক ১৫ মিনিট আগে, গুপ্তেকে অধিনায়কত্ব নিতে বলা হয়। তাকে তো এটাও বলা হয়, এই অধিনায়কত্বটা শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্যে!
নাহ, নাটকের তখনও শেষ হয়নি। গুপ্তেকে প্রস্তাব দিলেও শেষ মুহুর্তে পাশার দান উল্টে ভিনু মানকাড়কে দেওয়া হয় অধিনায়কত্ব। তাও কিভাবে? ড্রেসিং রুমের পাশে টয়লেট থেকে ভিনুকে ধরে এনে!
বলাই বাহুল্য, মাদ্রাজ টেস্টে ভারত হেরে যায়!
- পঞ্চম টেস্ট- দিল্লী
চতুর্থ টেস্টে তো দায়িত্ব দেওয়া হল ভিনুকে। কিন্তু মাঠের খেলায় দেখা গেল ভিনু ঠিক দলের সাথে যুক্ত হচ্ছেন না। তাকে খেলার মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছেনা। এরপর যা হয়, পঞ্চম টেস্টের আগেই ভিনুকে বরখাস্ত করা হল।
এরপর নির্বাচকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন তারা গুলুব্রাই রামচাঁদকে অধিনায়কত্ব দেবেন। সেই সিদ্ধান্ত নেবার পর বিসিসিআই এর পক্ষ থেকে একজন হোটেলে গেল রামচাঁদকে দায়িত্ব দিতে। গিয়ে দেখে, ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ার ভয়ে খেলোয়াড়েরা সব আগেই হোটেল ছেড়ে দিয়েছে।
বিসিসিআই এর যে অফিশিয়াল প্রস্তাব নিয়ে গেছিলেন, তিনি ফিরে এলেন। রামচাঁদকে আর দায়িত্বের প্রস্তাব দেওয়া হল না। আর এরপর নির্বাচকেরা আবার সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। তাঁরা রামচাঁদের বদলে অধিনায়কত্ব দিলেন হেমু অধিকারীকে। শুধু হোটেলটা আগে না ছাড়লে যে দায়িত্বটা রামচাঁদই পেতেন।
সে ম্যাচে হেমু অধিকারী সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন,দুই ইনিংসে করেন ৬৩ আর ৪০। বল হাতেও নেন ৩ উইকেট। টেস্টটা ভারত ড্র করে।
এরপর কি হয়?
নির্বাচকদের সিদ্ধান্তের দোলাচল চলতে থাকে এই সিরিজটার পরেও। এরপরের সিরিজটা ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ইংল্যান্ডের মাটিতে। সে সিরিজের দল ঘোষণার সময় দেখা গেল দলে রামচাঁদ, ভিনু মানকাড় আর হেমু অধিকারীর কেউই দলে নেই! অধিনায়কত্ব দেওয়া হয় দত্ত গাইকোয়াড়কে; যার ঝুলিতে ছিল মাত্র ৬ টেস্টের অভিজ্ঞতা ।
তবে, এরপরও গল্পটা শেষ হয়নি। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয় যখন গোলাম আহমেদ অবসর ভেঙে ফিরে আসেন। তবে তাতে নির্বাচকেরা বিশেষ কর্ণপাত না করলে গোলাম আহমেদ আবার অবসর নিয়ে নেন!
কি ভাবছেন? অধিনায়কত্বের চেয়ারটা থেমে গেছে? নাহ! তবে এবারে আর নির্বাচক খেলোয়াড়দের কোন দায় নেই। দত্ত গাইকোয়াড়ের হঠাৎ ব্রঙ্কাইটিস ধরা পড়লে তিনি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন আর তখন রয়কে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়!
ভারত পায় ৭ টেস্টে ভিন্ন ৬ অধিনায়কের স্বাদ!