দেবদর্শন, শেষবার!

গদ্যের পৃথিবীর ধূসর দস্তাবেজের তলায় শুকনো ব্যাট-বলের স্কোরকার্ড। তার ভেতর কার্ডাস নেভিল থেকে রিচি বেনো হয়ে হাজারে হাজারে ক্রিকেট লিখিয়ের ক্রিকেটীয় সাহিত্যের নদী বয়ে গেছে বছরের পর বছর। ক্রিকেট রোম্যান্টিসিজমের গন্ধ চিরকাল উইলো কাঠের এসেন্স, শীতের সকালে লাল বলের ইনসুইং আর?

একটা আস্ত শচীন রমেশ টেন্ডলকর। দ্বিমত? এ বিশ্বে কেউ করার সাহস পান নি আজও।

১.

১৯৯৯ বিশ্বকাপ চলছে। বিখ্যাত ম্যানচেস্টার পিচ। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে অনেক। সকাল থেকে হাওয়া চলছে শিরশিরে। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় রোদের দেখা নেই। ভারতের মিডিয়া থেকে ইংল্যান্ডে খবরটা পৌঁছেছে কয়েকদিন আগেই। কার্গিল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

আর সেইদিন বেলায় ভারতের মুখোমুখি পাকিস্তান। পাকিস্তানের বোলিংয়ে আকরাম-শোয়েব আর ভেল্কিবাজ সাকলাইন। পরিস্থিতি এমন যে ভারতের সবচেয়ে জাঁদরেল সিং কপিল দেব ও বলে দিলেন আজ যেন শচীন ওপেন না করে। ফার্স্ট ডাউন ও না।

শোয়েব-আকরামের প্রথম স্পেল শেষ হলে দরকারে চার নম্বরে। পিচে আগুনে স্যুইং করবে আজ। ওর উইকেট পড়লেই কিন্তু দেশে আগুন লেগে যাবে। কপিলের সাথে সহমত হন নি এমন একজনও সম্ভবত সেদিন ছিলেন না প্রেসবক্সে। যিনি ছিলেন তিনি চুপ করে বসেছিলেন ড্রেসিংরুমে। তিনি স্বয়ং শচীন।

এজবাস্টনে ভারতের ইনিংস শুরু হতেই ডাগআউটের সামনে দিয়ে নেমে এল একখণ্ড ভারতবর্ষ। মাথায় তেড়ঙা পতাকা নয়, একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া দেশের কার্গিল বর্ডারে সেনার পোশাকে তার লৌহ কঠিন মানসিকতায় বর্ম করে নামলেন শচীন। খেলার আগে শুধু একটা কথাই বলেছিলেন – আমি পিছিয়ে আসব? সবাই কেন আউটের কথা ভাবছে? আমি তো ভারতকে জেতাতে নামছি।

তারপর ফার্স্ট স্পেলে শোয়েবের সামনে জুজু হয়ে থাকা ভারতকে এনে দিলেন একটার পর একটা স্কোয়ার কাট আর কভার ড্রাইভ, সেট করে দিলেন মোমেন্টাম!

ক্রিকেটার? না! দেবতা ক্রিকেট ব্যাটটুকু তেইশ বছর ছুঁয়েছিলেন মাত্র!

২.

২০০৩ বিশ্বকাপ। নেট প্র‍্যাকটিসে নামছেন ভারতের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার। কিন্তু নেটে গিয়েই ফিরে এলেন বাইরে। দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করে বল ছুঁড়তে বললেন টেনিস বলে৷ বিশ্বকাপের এক একটা ম্যাচের আগে এক একটা লেংথ সেট করে দিতেন শচীন। সেখান থেকে বল ছোঁড়া হত তাকে। কিন্তু এমন অদ্ভুত রহস্য কেন? আলাদা আলাদা ম্যাচে আলাদা আলাদা লেংথ কেন? পিচ তো বাইশ গজই!

রহস্যটা ফাঁস করে ছিলেন গ্যারি কার্স্টেন অনেকদিন পর। আসলে শচীন ম্যাচের আগে দেখে নিতেন বিপক্ষ বোলারের নাম তাঁদের বলের গতি। শচীন চাইতেন ম্যাচের আগের দিন সেই বোলারদের খেলতে গেলে প্রতিটা বল মিডব্যাট হবার যে শব্দ তরঙ্গ তা গতির আর লেংথের ভেদে আলাদা আলাদা হয়। সশীন নিজের ব্রেনে এই দোলন বা ছন্দটা নি:শব্দে রেকর্ড করে নিতেন।

শচিনীয় পৃথিবীর আরও বড় রহস্য ফাঁস হয়েছিল ঐ বিশ্বকাপের ফিরতি ফ্লাইটে ফাইনালে হেরে দেশে ফেরার পর। শচীন মুখফুটে কিছু বললেন না। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েও মলিন হাসি। দেশ জেতেনি। সকলের অগোচরে এক সাংবাদিক বললেন, ‘ছেলেটা দুটো আঙুলে চিড় নিয়ে বিশ্বকাপে ৬৭৩ রান করে গেল, ও কি মানুষ?’

এর উত্তর খুঁজতে চায় না কেউ। অবচেতনে থাকা দেবতা যেমন মাটির পৃথিবীতে নেমে এলে আমরা চুপ হয়ে যাই, শচীনের দেবতা হয়ে ওঠার মার্গ আর আধুনিক ভারতের উত্থানটা একেবারে যেন উঠে এল সমান্তরাল পথে, কপিল বলতেন দেবতা।

তাঁকে আউটসুইংটুকু দিয়েছিল বাকিটা নিজের গড়ে নেওয়া তেমনই ষোলো বছরের শিয়ালকোটে ছোট্ট ছেলেটাকে দেবতা দিয়েছিলেন তাঁর আত্মাকে। সেই আত্মার স্তন্যে আসমুদ্র হিমাচলকে ধন্য করে দিতে শচীন নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন প্রতিটা দিন। জীবনের শেষ ইনিংসে আউট হবার পর যখন দাদা অজিতকে টেলিফোন করে কেউ জানতে চায় টেকনিকে কি ভুল ছিল? – তখন মনে পড়ে ইমরান খানকে যিনি বলেছিলেন জন্ম আর মৃত্যুর মাঝের এই বাইশগজে থামার কোনো জায়গা নেই, শেষ দিন যেন ওপারে গিয়ে বলতে পারি  – ‘আমি নিজের সেরাটা দিয়েছি’ – শচীন এই মিথকে পাল্টে পরতে পরতে বুঝিয়ে দিলেন প্রতিভার পান্ডুলিপি দক্ষ সম্পাদকের হাতে পড়লে তা হয়ে ওঠে কালজয়ী গ্রন্থ।

এই অনন্ত বাইশগজের মাঝে দৌড় একদিন তাকে বানিয়ে দিল দেবতা, ঘটনাক্রমে নামের পাশে ক্রিকেটার লেখা থাকলেও ওয়াংখেড়ের শেষ কান্নার পর তিনি আধুনিক ভারতের বিশ্বস্ত মন্দির-মসজিদ-গীর্জার ভেতরে থাকা নিরাকার প্রাণবায়ু, সেই প্রাণবায়ু আমাদের ছুঁয়ে গেছে, স্বাধীনোত্তর একটা জাতীর বুকে দাঁড়িয়ে একজন শচীন টেন্ডুলকারকে ওয়াংখেড়ের সবুজ গালিচা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছি আমরা!

কত বছর কেটে গেছে, তবু বিশ্বাস করি রান-উইকেটের শুকনো উপাসনাগারে এক জন্মে এর চেয়ে বড় ঈশ্বর দর্শন আর ভারতবাসীর হতে পারে না, পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link