রনি তালুকদার, দ্য ম্যাচ উইনার

বাংলাদেশের জার্সি গায়ে মোটে একটি ম্যাচ খেলেছেন রনি তালুকদার। তাও সেটি দীর্ঘ ৮ বছর আগে। এরপর জাতীয় দলের দরজা এক প্রকার বন্ধই হয়ে গিয়েছে তাঁর জন্য। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অতটাও খারাপ করেননি রনি। ২১ রান করেছিলেন তিনি। এর পরেই কোনো এক অদ্ভুত কারণে আর একটিও সুযোগ মেলেনি। ব্রাত্যদের দলে নাম লিখিয়েছেন তিনি।

রনির পরে জাতীয় দলে বহু ওপেনার যাওয়া আসার মিছিলে শামিল হয়েছেন। কেউ কেউ রনির সম সক্ষমতার অধিকারী না হয়েও প্রচুর সুযোগ পেয়েছেন। রনির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা এখানেই পিছিয়ে গেছে। লাইম লাইটে আসতে যতটুকু ভাগ্য প্রয়োজন সেই ভাগ্যটা রনির হয়নি। তবে ভাগ্য বদলানোর কাজটা তিনি যথারীতিই চালিয়ে গিয়েছেন। রান করেছেন, ফরম্যাট ভেদে রানের গতি বাড়ানোর সামর্থ্য দেখিয়েছেন। কিন্তু ঐ যে, দিন শেষে কারোর সুনজরে পড়েন নি।

এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) শুরুটা দুর্দান্ত করেছিলেন রনি তালুকদার। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের বিপক্ষে ৬৭ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস খেলে হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা। রানের ছন্দ ধরে রেখেছিলেন পরের ম্যাচেও। প্রথম দুই ম্যাচ মিলিয়ে ১০৭ রান। রনি এরপরেই খেই হারিয়েছেন। রান করতে পারছিলেন না, রান করলেও ইনিংস বড় করতে পারছিলেন না। যার কারণে শুরুর ছন্দ মিইয়ে যায় পরের ম্যাচগুলোর ব্যর্থতায়।

কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ‘ইম্প্যাক্টফুল’ ইনিংস বলে একটা কথা রয়েছে। এই ফরম্যাটে গড় রানের চেয়ে প্রয়োজন ম্যাচ উইনিং ইনিংস। রানের চেয়ে প্রয়োজন বেশি স্ট্রাইক রেট। রনি তালুকদার এখানেই সফল ছিলেন। প্রথম দুই ম্যাচ বাদে তেমন রান করেননি। কিন্তু কোনো ম্যাচে দলের উপর চাপ বাড়াননি। কম বলে ছোট ছোট ইনিংস খেলেছেন। যেগুলো পরিসংখ্যানে হয়তো খুব বেশি রান যোগ করে না কিন্তু ম্যাচ পরিস্থিতিতে দারুণ অবদান রাখে।

অবশ্য প্রথম ম্যাচের পর আবারো রনি ঝলকের দেখা মিলেছে সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে ম্যাচে। রংপুর রাইডার্সের সামনে ১৭১ রানের লক্ষ্য। বাংলাদেশের উইকেটে সেটাই বড় লক্ষ্য বলা চলে। এমন সময়ে প্রয়োজন চেজ করা দলের উড়ন্ত শুরু। তার গুরুদায়িত্বটা পড়লো রনি তালুকদারের উপর।

রনি স্ট্রোক খেলতে পছন্দ করেন। নির্ভীক ক্রিকেটিং শট খেলতে দ্বিধাবোধ করেন না। সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে এ ম্যাচে সেই ইন্টেন্টেই তিনি ব্যাটিং শুরু করলেন। শুরু থেকেই স্ট্রোক মেকিংয়ে নজর দিলেন। তাতে অবশ্য প্রথমে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ পেলেন না। বেশির ভাগ শটই পুরোপুরি টাইমিং না হওয়াতে নো ম্যানস ল্যান্ডে গিয়ে পড়ছিল। কিন্তু ঐ ইন্টেন্টেই পরে সফলতা পেলেন তিনি।

৬ ওভারের পাওয়ার প্লে শেষে ৫৯ রান। তাতে রনির একারই ২৩ বলে ৩৯ রান। রংপুর রাইডার্সের যেমন উড়ন্ত শুরু প্রয়োজন ছিল ঠিক তেমনটাই হল। তবে লক্ষ্যটাকে আরো হাতের মুঠোয় আনতে প্রয়োজন ছিল রনির উইকেটে টিকে থাকা। এমতাবস্থায় রনি আগের মতোই হিটিংয়ে নজর দিলেন। রানের গতিটাকে বন্ধ করতে চাইলেন না। রনির এমন আগ্রাসী পরিকল্পনা কাজে দিল বেশ।

৬ ওভারের ৫৯ থেকে ১০ ওভার পূর্ণ হওয়ার আগেই রংপুর রাইডার্সের ইনিংসে ১০০ রান। রনি আউট হয়েছেন ঠিক ঐ সময়েই। তবে ম্যাচ ততক্ষণে রংপুরের দিকে ঝুঁকে গেছে। ২৭ বলে ব্যক্তিগত ফিফটি তুলে নিয়ে রনি তালুকদার ফেরেন ৩৫ বলে ৬৬ রানের ইনিংস খেলে। দুর্দান্ত এ ইনিংসে রনি খেলেছেন ৮ টি চার ও ৩ টি ছক্কার মার।

রনির ইনিংস কতটা ইম্প্যাক্টফুল ছিল, তা বোধহয় খোলাসা না করলেও চলে। তবে রংপুরের ইনিংসের ভিত কিভাবে গড়েছেন তার একটা নমুনা তুলে ধরা যেতে পারে। ইনিংসের তখন ৮ম ওভার। থিসার পেরেরা বলে আসলেন। রনি তখন রয়েছেন ব্যক্তিগত ৪১ এ। কিন্তু পাওয়ার প্লে’র প্রায় ১০ করে রান রেট তখন কিছুটা কমে ৯-এ নেমে গিয়েছে।

এমন সময়ে রানের গতিটা বাড়ানোর জন্য পেরেরাকে চার্জ করা শুরু করলেন রনি তালুকদার। থিসারার করা দ্বিতীয় বলে চার দিয়ে শুরু করলেন। এরপরের দুই বলে হাঁকালেন টানা দুই ছক্কা। এতেই রংপুর রাইডার্সের রান গিয়ে দাঁড়ালো ৮ ওভারে ৮৪। রংপুর ম্যাচ জেতার দুর্দান্ত মোমেন্টাম সেখানেই পেয়ে যায়।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশি ব্যাটারদের ঠিক এই জায়গাতেই দুর্বলতা। নিজের আগ্রাসী ব্যাটিং ইনিংসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন খুব কম ব্যাটার। মানসিকতার দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এই জায়গাটায় বাংলাদেশি অন্যান্য ব্যাটারদের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে রনি তালুকদার।

হ্যাঁ। দিনশেষে তাঁর পরিসংখ্যান হয়তো খুব সমৃদ্ধ নয়। কিন্তু একা হাতে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন তিনি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ম্যাচ উইনার হওয়ার মতো সব ধরনের রসদ আছে তাঁর মধ্যে।  সেটা বিপিএলে বরাবরই দেখিয়েছেন তিনি। কিন্তু ঠিক সেভাবে চোখে পড়েন না। তাই দিনশেষে রনি তালুকদার জাতীয় দলের রাডারে থেকে গিয়েছেন অভাগাদের কাতারেই।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link