‘দ্য রেড লাইট উইল কাম অন’ – কাঁপতে কাঁপতে ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে কথাটা বলছিলেন রবি শাস্ত্রী। বলা শেষ হতে না হতেই লাল বাতি জ্বললো। ৪০ হাজার কণ্ঠের চিৎকারে ততক্ষণে শাস্ত্রীর কণ্ঠটা ম্লান হয়ে গেল। টিভিতে মুরালি কার্তিকের কালো হয়ে আসা মুখটা ভাসলো, আর শোনা গেল – ‘দিস ইজ আ ফেমাস উইন!’
__________________
সে ছিল অন্যরকম এক সময়। ম্যাচের আগে সব সময়ই যে-ই বাংলাদেশের অধিনায়ক থাকুন না কেন বলেই নামতেন, ‘আমরা মাঠে নামার আগেই হার মানছি না।’ শোনাতেন, কোনো ভাবে একটা জয় আদায়ের আশার বানী। কিন্তু, যিনি বলতেন আর যারা শুনতেন – কেউই সেই কথাগুলো ঠিক বিশ্বাস করতেন না।
এমনই একটা সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছিল ভারত। সময়টা ২০০৪ সাল। বরাবরের মত সেই সিরিজটাও এক তরফাই ছিল। দুই টেস্টের সিরিজ দিয়ে শুরু হয় সৌরভ গাঙ্গুলির দলের লম্বা বাংলাদেশ সফর। দু’টোতেই বাংলাদেশ হারে ইনিংস ব্যবধানে। একমাত্র মোহাম্মদ আশরাফুলের ১৫৮ রানের ইনিংসটা বাদ দিলে টেস্ট সিরিজ থেকে স্বাগতিকদের কোনো প্রাপ্তিই ছিল না বলা যায়।
টেস্টের পর ওয়ানডে সিরিজ শুরু।
প্রথম ম্যাচটায় ভাল লড়াই করলো বাংলাদেশ। মোহাম্মদ কাইফের ৮০ রানের ইনিংসে ভর করে আট উইকেটে ২৪৫ করেছিল সফরকারীরা। অভিষেক হয় মহেন্দ্র সিং ধোনির, যদিও তিনি ফেরেন বিনা রানে। জবাবে বাংলাদেশ ২৩৪ অবধি যেতে পারে, আট উইকেট হারিয়ে। অধিনায়ক হাবিবুল বাশার ও অভিজ্ঞ পাইলটের ব্যাট থেকে আসে হাফ সেঞ্চুরি।
দর্শকরা তখন এই টুকটাক লড়াই দেখতে পারলেই খুশি। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের সেই পাকিস্তান বধের সুখস্মৃতি ততদিনে ম্লান। এরপর একটা জয় এসেছিল কেবল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, সে বছরেরই মার্চে।
এক বছরে দুই জয় ব্যাপারটাই তখন ছিল কল্পনার অতীত, আর সামনে যদি হয় মাত্র এক বছর আগেই বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা ভারত – তখন তো আর কথাই নেই।
এমন একটা সময় অনুষ্ঠিত হয় সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ। সেদিনটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিক থেকে এমনিই ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শততম ওয়ানডে খেলতে সেদিন মাঠে নামে বাংলাদেশ।
তবে, শীতের সেই সকালে সেটাই দিনের বড় ঘটনা নয়। বিরোধী দলের ডাকে দেশে ১২ ঘণ্টার হরতাল চলছে। এমন সময় দিবারাত্রির সেই ম্যাচ মাঠে গড়ায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে, আজকাল যে মাঠ কেবলই ফুটবলের।
ভারত টানা জয় পেয়ে একটু বিশ্রাম দিতে চাইলো কয়েকজনকে। ম্যাচটায় মাঠে নামলেন না স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার, হরভজন সিং, ইরফান পাঠান ও রাহুল দ্রাবিঢ়। বাংলাদেশের সেই বিলাসিতার সুযোগ নেই। পেস বোলিং অলরাউন্ডার মুশফিকুর রহমানের জায়গায় ফেরানো হল মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। ১৫ মাসের বিরতির পর আসলেন মাশরাফি। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন – এই একটা সিদ্ধান্তর জন্য সেদিন টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে আজীবন ঋণী থাকবে বাংলাদেশ ক্রিকেট।
টসে জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ। কোচ ডেভ হোয়াটমোর তখন ডান হাতি-বাম হাতি কম্বিনেশনে ইনিংস শুরুর পক্ষপাতি। ক্রমাগত ওপেনিংয়ে নাফিস ইকবালের সাথে চেষ্টা করা হচ্ছে মোহাম্মদ রফিককে।
ওপেনিং জুটি আবারো ব্যর্থ। মাত্র ২৬ রানে দু’জন ফিরলেন সাজঘরে। ৩৭ রানের মাথায় তিন নম্বরে নামা আগের ম্যাচের হাফ সেঞ্চুরিয়ান সুমনও ফিরে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর বাইশ গজে তখন অজিত আগারকার-জহির খানদের দাপট।
এমন সময় মাঠে নামলেন আফতাব আহমেদ, বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনন্ত আক্ষেপ। একটু নিজেকে নিয়ে সচেতন হলে কিংবা যদি ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) না যেতেন – বড় সম্পদ হতে পারতেন জাতীয় দলের জন্য। সেদিনটা ছিল আফতাবের। পাঁচ চার ও এক ছক্কায় ৬৭ রান করেন এই ডান হাতি।
সাথে মোহাম্মদ আশরাফুলের ২৮, খালেদ মাসুদ পাইলটের ২০ আর খালেদ মাহমুদ সুজনের ১৭ -তে ইনিংসটা বড় হচ্ছিল। কিন্তু বড় জুটি না আসায় রানটা ২০০’র নিচে আটকে যাওয়াটা প্রায় নিশ্চিতই ছিল।
তবে, ‘পাগলা’ শো তখনও বাকি। পাগলা মানে সেকালের পাগলাটে-খ্যাপাটে মাশরাফি। ৩৯ বলে সেদিন মাশরাফি ৩১ রান করেন, শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন। আর দশম ব্যাটসম্যান তাপস বৈশ্য ১৩ বলে ১৭ রান করেন। নবম উইকেট জুটিতে দু’জন যোগ করেন মহামূল্যবান ৩৯ রান। বাংলাদেশ নয় উইকেটে ২২৯ রান। তাপস সেদিন ছিলেন আনসাঙ হিরো। পরে মিতব্যয়ী বোলিংয়ে দুই উইকেটও নেন।
ভারত শীর্ষ কয়েকজনকে ছাড়া নেমেছিল, তারপরও ২৩০ রানের স্কোর তাঁদের জন্য বড় কিছু নয়। কিন্তু, মাশরাফি যে সেদিনকার চিত্রনাট্যটা নিজের মত করে সাজিয়েছিলেন।
ইনিংসের তৃতীয় বলে মাশরাফির ইনস্যুইঙ্গারে বোল্ড নজফগরের নবাব, মানে বীরেন্দ্র শেবাগ। তাপস ফেরান যুবরাজ সিংকে। পাঁচ রানের মধ্যে দুই উইকেট নেই ভারতের। ৫১ রানের মাথায় ফিরলেন প্রিন্স অব ক্যালকাটা, ফেরালেন সুজন।
এরপর শ্রীধরণ শ্রীরাম ও কাইফ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। ৬৩ রানের জুটি গড়ে ম্যাচটা প্রায় বেরই করার পথে ছিলেন দু’জন। কাইফ ৪৯ ও শ্রীরাম ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র হাফ সেঞ্চুরির দেখা পান।
তবে, এই শ্রীরামই বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরালেন। বল না দেখে তাঁর ভুতুড়ে এক দৌড় কাজে লাগিয়ে স্ট্যাম্প উপড়ে দেন খালেদ মাসুদ পাইলট। বাকি গল্পটা নির্দিষ্ট কোনো মানুষ বা খেলোয়াড় নন, দল হয়ে ওঠা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ছিল। ফিল্ডিং ইউনিট হিসেবে সেদিন বাংলাদেশ ছিল বিশ্বসেরা।
দিনেশ মঙ্গিয়া ফিরলেন তাপসের সামনে, লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে পড়ে। মাশরাফির বলে এমএস ধোনির ডাইভিং এক ক্যাচ নিলেন ৩২ বছর বয়সী সুমন, যার ফিল্ডিং নিয়ে কখনোই খুব একটা সুনাম ছিল না। এর পর ফিরলেন কাইফ, ভারতের শেষ ভরসা। রাজিন সালেহ’র তুখোড় এক আন্ডার আর্ম থ্রো! ১৭০ রানে ভারতের সাত ব্যাটসম্যান তখন প্যাভিলিয়নে। ধারাভাষ্যে হার্শা ভোগলে, সুনীল গাভাস্কারদের কণ্ঠস্বরও তখন কাঁপছে।
১৭২ রানের মাথায় অষ্টম ব্যাটম্যান হিসেবে ফিরলেন আগারগার। মোহাম্মদ রফিকের দ্বিতীয় শিকার তিনি।
এর মধ্যে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন যোগিন্দর শর্মা। জহিন খানকে নিয়ে ৩২ রানের জুটি গড়লেন। নিজে ২২ বলে ২৯ রান করলেন। তবে, অভিজ্ঞ সুজন ফিরিয়ে দিয়েছেন জহির খানকে, মাশরাফির ক্যাচ বানিয়ে। ‘দিস ম্যান ইজ এভ্রিহোয়্যার টুডে’ – ধারাভাষ্যে বসে ম্যাচে মাশরাফির ইম্প্যাক্টটা এক বাক্যে বুঝিয়ে দিলেন শাস্ত্রী।
হাতে আর চার ওভার। ভারতকে করতে হত ২৬ রান। বাংলাদেশের চাই এক উইকেট। শেষটা হল আরেকটা তুখোড় রান আউটে, এবার আফতাব আহমেদ। পয়েন্ট থেকে বল ছুঁড়লেন। বেল ভাঙলো, বাজলো বাংলাদেশের জয়ের বাদ্য। লাল বাতি জ্বলে ওঠাটা ছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা। তখনও ১৫ রান দূরে দাঁড়িয়ে সৌরভ বাহিনী। বিশ্বাস করুন টিভি সেটের সামনে এই দৃশ্যমান দৃশ্য টাকে সেদিন বিরাট অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল!
সৌরভ বলতে বাধ্য হলেন, ‘বাংলাদেশ কৃতিত্ব দিতেই হবে। ওরা মাঠে অসাধারণ ইফোর্ট দিয়েছে। বোলিংকে সাপোর্ট করে গেছে অসাধারণ ফিল্ডিং।’
আমরা বরং বলি, সেই রাতে অসাধারণ হয়ে উঠেছিল সোনার বাংলাদেশ!
দেশের মাটিতে প্রথম জয়, প্রথম বারের মত ভারতের বিপক্ষে জয়, শততম ওয়ানডেতে জয় – সেদিনটাকে চাইলেও ভোলা যায় না। ভোলা যাবে না ডেভ হোয়াটমোরকেও – জয়ের আড়ালের রূপকার তো ছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ান কোচই!