এন্টার দ্য ডন!

স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনা এই একটা মানুষের জন্য দুই নাম্বার থেকে আরম্ভ হয়। কোনো খেলাতে প্রথম আর দ্বিতীয় স্থানের অধিকারীদের মধ্যে এতটা তফাৎ নেই যতটা স্যার ডনের সঙ্গে অন্যান্য গ্রেট ব্যাটসম্যানদের। ৫২ টেস্ট, ২৯ সেঞ্চুরি, গড় ৯৯.৯৪ – এই সংখ্যাগুলোই যথেষ্ট ডনের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে।

ডনের ব্যাটিংয়ে কি কোন দুর্বলতা ছিল? অনেকের কাছে হয়ত প্রশ্নটাই হাস্যকর। যার ব্যর্থতা (বডিলাইন সিরিজ, গড় ৫৬.৫৭) অন্যদের সাফল্যের সমান, তার আবার কিসের দুর্বলতা?

কিন্তু পুরনো দিনের লেখা পড়লে দুই একটা পয়েন্ট উঠে আসে। যেমন ভিজে উইকেটে ব্যাটিং। তখনকার দিনে পিচে কাভার না থাকায় বৃষ্টি পড়লে উইকেট আঠালো হয়ে যেত। এই ধরনের উইকেটে ব্র্যাডম্যানের পারফর্মেন্স সাধারন মানুষের স্তরে নেমে আসত। এই ধরনের ১১টি টেস্টের ১৫ ইনিংসে ডনের মোট সংগ্রহ ২৮৪ রান, গড় ২০.২৯।

এই ক্রাইটেরিয়ায় ওনার চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিলেন ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান নামে খ্যাত জর্জ হ্যাডলি (এই ধরনের উইকেটে ১৩ ইনিংসে ৩৯.৮৫ গড়ে ৫১৮ রান করেন জর্জ)। ডনের আগের প্রজন্মের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভিক্টর ট্রাম্পার বিখ্যাত ছিলেন বাজে উইকেটে রান করার জন্যে। বিখ্যাত লেখক নেভিল কার্ডাস এই কারনে হ্যাডলিকে ডনের চেয়ে ভালো ‘অল উইকেট’ ব্যাটসম্যানের শিরোপা দেন। জ্যাক হবসও ভিজে উইকেটে ভালো খেলতেন বলে শোনা যায়।

দ্বিতীয় পয়েন্ট যেটা উঠে আসে, অবশ্য তার জন্যে ডনকে কোনমতেই দায়ী করা চলে না, তা হচ্ছে যাদের বিরুদ্ধে ডন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করেছেন সেই বোলারদের মান। স্যার ডনের খেলা শ্রেষ্ঠ বোলারদের নাম ছিল হেডলি ভেরিটি, অ্যালেক বেডসার, মরিস টেট এবং হ্যারল্ড লারউড। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম লারউডের – কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজের সৌজন্যে।

কিন্তু, লারউডের টেস্টে মোট উইকেটের সংখ্যা ৭৮, গড় ২৮.৩৬। বডিলাইন সিরিজ (তার শেষ সিরিজ) বাদ দিলে সেই সংখ্যা নেমে দাঁড়াবে ১৬ টেস্টে ৪৫, গড় ৩৪.৮৪। সেই সিরিজের পর আর কোন টেস্ট খেলেন নি লারউড। অর্থাৎ লারউডের বোলিং যখন পিক করছে তখনই তার ক্যারিয়র শেষ করে দেওয়া হয়।

বাঁ হাতি স্পিনার হেডলি ভেরিটি রেকর্ড যথেষ্ট ভাল (২৪.৩৮ গড়ে ১৪৪ উইকেট)। হয়ত তা আরও ভালো হত যদি প্রতিপক্ষ টিমে ব্র্যাডম্যান নামের এক ব্যাটসম্যান না থাকতেন। তবে তিনি ওয়ার্ন বা মুরলির মানের স্পিনার ছিলেন না।

এছাড়া ছিলেন অফ ব্রেক বোলার মরিস টেট (২৬.১৬ গড়ে ১৫৫ উইকেট) ও মিডিয়াম পেসার অ্যালেক বেডসার (২৪.৯ গড়ে ২৩৬ উইকেট)। বেডসার সম্ভবত ব্র্যাডম্যানের খেলা সবচেয়ে উঁচুমানের বোলার ছিলেন।

কিন্তু উনি যখন ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করেন তখন ডনের ক্যারিয়র প্রায় শেষের মুখে। সুতরাং সেরা ফর্মের বেডসারের মুখোমুখি হন নি ডন। তবুও মাত্র ১০টি টেস্টের মধ্যে তিনি ডনকে ৬ বার আউট করেন।

যে চারজন বোলারের উল্লেখ করলাম তারা সর্বকালের নিরিখে বোলার হিসেবে কোন জায়গায় থাকবেন? এই বিষয়ে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায় আই সি সির রেটিং থেকে। এখানে বোলার এবং ব্যাটসম্যানদের পয়েন্ট দেওয়া হয় পরিস্থিতি এবং তাদের পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে। ৮৫০ বা তার বেশি পয়েন্ট পাওয়া ক্রিকেটারদের উঁচু স্তরের ক্রিকেটার হিসেবে মেনে নেওয়া যেতে পারে।

উল্লিখিত চারজনের সর্বাধিক পয়েন্ট হল এইরকম –  বেডসার – ৯০৩, টেট – ৮৫৭, ভেরিটি – ৮৫৩ এবং লারউড – ৭২০।

এরমধ্যে বেডসারের পয়েন্ট ব্র্যাডম্যান খেলাকালিন ৫০০র নিচে ছিল। এবং লক্ষ্য করার বিষয় যে এই চারজন বোলারই ইংল্যান্ডের। এছাড়াও ব্র্যডম্যানকে ৫ বার আউট করেছেন বাওেস (টেস্টে ২২.৩৪ গড়ে ৬৮ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৭০১)।

এবার আমরা ফিরে আসবো আমাদের চারজন আলোচিত ক্রিকেটারদের প্রসঙ্গে। দেখা যাক তারা তাদের ক্যারিয়রে কোন ধরনের বোলিঙের সম্মুখীন হয়েছেন। এখানে শুধু সেই বোলারদের নামই উল্লেখ করব যারা তাদের ৫ বা তার বেশিবার আউট করেছেন।

  • সুনীল গাভাস্কার

ডেরেক আন্ডারউড (২৫.৮৪ গড়ে ২৯৭ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৯০৭), মাইকেল হোল্ডিং (২৩.৬৯ গড়ে ২৪৯ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৮৬০), ইমরান খান (২২.৮১ গড়ে ৩৬২ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৯২২), ইয়ান বথাম (২৮.৪ গড়ে ৩৮৩ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৯১১) এবং ম্যাল্কম মার্শাল (২০.৯৫ গড়ে ৩৭৬ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৯১০)।

  • ভিভ রিচার্ডস

দুটো নাম ওপরের লিস্টের সঙ্গে কমন – ইয়ান বথাম এবং ইমরান খান। এ ছাড়া রয়েছেন ডেনিস লিলি (২৩.৯২ গড়ে ৩৫৫ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৮৮৪), কপিল দেব (২৯.৬৩ গড়ে ৪৩৪ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৮৭৭) এবং জেফ টমসন (২৮.০১ গড়ে ২০০ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৮০৬)।

  • শচীন টেন্ডুলকার

জেমস অ্যান্ডারসন (২৬.১৩ গড়ে ৬৭৫ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৯০৩), মুরলী (২২.৭৩ গড়ে ৮০০ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৯২০), ম্যাকগ্রা (২১.৬৪ গড়ে ৫৬৩ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৯১৪) এবং ডোনাল্ড (২২.৯৫ গড়ে ৩৩০ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৮৯৫)। এছাড়াও রয়েছেন গিলেস্পি (২৬.১৪ গড়ে ২৫৯ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৮১২)।

  • ব্রায়ান লারা

ম্যাকগ্রা, ডোনাল্ড, ওয়ার্ন (২৫.৪২ গড়ে ৭০৮ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৯০৫), কুম্বলে (২৯.৬৫ গড়ে ৬১৯ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৮৫৯)। এছাড়াও আশ্চর্যজনক ভাবে লারাকে ৮ বার আউট করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দ্রে নেল (৩১.৮৬ গড়ে ১২৩ উইকেট, বেস্ট রেটিং ৭৬৩)।

পাঠকেরা নিশ্চই খেয়াল করেছেন এই বোলারদের লিস্ট থেকে বহু গ্রেট বোলারদের নাম বাদ চলে গেছে। অ্যান্ডি রবার্টস, রিচার্ড হ্যাডলি, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, সাকলেইন মুশতাক, ডেল স্টেইন, শন পোলক ইত্যাদিরাও ছিলেন আমাদের আলোচ্য চারজনের মধ্যে অন্তত দুইজনের বিরুদ্ধে।

বোলারদের নামগুলো দেখে সম্ভবত এই নিষ্কর্ষে পৌছনো যায় যে ডনের তুলনায় আমাদের আলোচ্য চারজন ব্যাটসম্যান উন্নততর মানের বোলিঙের বিরুদ্ধে তাদের রানগুলো করেছেন।

এবং যে ক্ষেত্রে উঁচু মানের বোলারদের ডন খেলেওছেন, সেক্ষেত্রেও সেই দলের সামগ্রিক বোলিং আক্রমণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ (মার্শাল, রবার্টস, হোল্ডিং, গার্নার / ওয়ালশ, অ্যামব্রোস, বিশপ), অস্ট্রেলিয়া (লিলি, টমসন / ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন, লি), পাকিস্তান (ইমরান, সরফরাজ, কাদির / ইমরান, আক্রাম, ওয়াকার, সাকলেইন) বা দক্ষিণ আফ্রিকার (ডোনাল্ড, পোলক / স্টেন, পোলক, এন্তিনি) মতো ভয়াবহ ছিল না। সেই সময়কার সবচেয়ে ভয়ংকর বোলিং আক্রমণ ছিল খোদ অস্ট্রেলিয়ার – লিন্ডওয়াল ও মিলারের নেতৃত্বে।

যে বোলার এবং বোলিং আক্রমন সুনীল, ভিভ, শচীন বা লারা ফেস করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ডন কেমন খেলতেন তা নিয়ে আলোচনা করে মনে হয় না আমরা কোনোরকম কনক্লুশনে পৌঁছতে পারব। তাই সেই চেষ্টা না করে এবং স্যার ডনকে সসম্মানে প্রথম স্থান ছেড়েই আমাদের আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link