সে অনেক আগের কথা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টিভি শো, পত্রিকার খেলার পাতা, সব জায়গায় একটা ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছিল- নেটে হাত ঘোরাচ্ছেন কে এল রাহুল!
আদতে তিনি একজন উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান, ওপেনিংয়েও নেমে যান প্রায় ম্যাচেই। তাই এমন কাউকে বল ঘোরাতে দেখলে কিছুটা হাস্যরস আপনার মধ্যে জমতে পারে। কিন্তু যদি একটু গভীরভাবে ভেবে দেখেন, তাহলে দেখবেন এখানে আছে রাহুলের প্রচেষ্টা- ঐকান্তিক প্রচেষ্টা!
আর হবে নাই বা কেন, রাহুলের যে দলে সুযোগই মিলছিল না। ওপেনিং জায়গাটা দীর্ঘদিন ধরেই সামলাচ্ছেন রোহিত শর্মা আর শিখর ধাওয়ান। ওয়ান ডাউনেও বিরাট কোহলি থিতু। উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে তো দলে ছিলেন সর্বকালের সেরাদের একজন- মহেন্দ্র সিং ধোনি।
এই দলে তাই রাহুলের জায়গা পাওয়া একটু কষ্টকরই বলতে হবে। তবে রাহুল কিন্তু হাল ছাড়েননি। চেষ্টা করে গেছেন বা যাচ্ছেন বলা যায়।
গেল এশিয়া কাপের কথাই ধরুন না। টুর্নামেন্টজুড়ে রোহিত আর শিখর ছড়ি ঘুরিয়েছেন, রাহুলের আর সুযোগ কোথায়। তবে যেই না আফগানিস্তান ম্যাচে দুজনকে বিশ্রাম দেওয়া হল, রাহুলের সুযোগ মিলল, আরব আমিরাতের স্পিন স্বর্গে মুজিব, রশিদদের সামলে তিনি খেলে ফেললেন ৬০ রানের ইনিংস!
তবে তা খেললে কি হবে, পরের ম্যাচেই কিন্তু তিনি দল থেকে বাদ পড়ে গেছেন!
লোকেশ রাহুল, অভিষেকের সময়ই যার মধ্যে অমিত সম্ভাবনা দেখে ফেলেছিল সবাই। যার তুলনা দেওয়া হচ্ছিল সুনীল গাভাস্কারের সাথে। সেই লোকেশ রাহুল টি-টোয়েন্টি বাদে বাকি ফরম্যাটগুলিতে নিজের জায়গাই ধরে রাখতে পারছিলেন না। এমন না যে তিনি পারফর্ম্যান্স এর কারণে বাদ পড়ছিলেন, বরং তিনি বাদ পড়ছিলেন পারফর্ম করার পরও। কেননা, যে যে পজিশনে তিনি খেলতে পারেন তার সবগুলিতেই দলে সেরা কিংবা বিকল্পের অযোগ্য ব্যাটসম্যান ছিলেন।
লোকেশ রাহুল কিন্তু তারপরও পারফর্ম করা থামাননি। যেখানেই তিনি সুযোগ পেয়েছেন, ব্যাট হাতে যোগ্যতার প্রমাণ দেখিয়েছেন। নির্বাচকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। তা নির্বাচকদের চাপে ফেললে কি হবে, নির্বাচকেরা কি আর রোহিত, ধাওয়ান, কোহলি কিংবা ধোনীর ওপর চাপ ফেলতে পারেন?
পারেননি, আর তাই রাহুলকে নিজের স্বচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। টপ অর্ডারের খেলোয়াড় হয়েও তিনি চার,পাঁচ বা ছয়ে ব্যাট করেছেন দলের চাহিদা মেনেই!
বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না। প্রথম দুই ম্যাচে তিনি ব্যাট করেছেন চার আর ছয়ে। খুব বেশি ভাল করেছেন বলা যাবেনা, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সাথে ছয়ে নেমে ৩ বলে ১১ রান তো খুব বেশি খারাপও নয়।
দলের চাহিদা মেনে টপ অর্ডারের লোকেশ রাহুল হয়ে গেছিলেন লোয়ার অর্ডারের ফিনিশার। নিজের এই পজিশন বদলের মিউজিক্যাল চেয়ার অবশ্য আরো কিছুদিন চলত, কিন্তু এর মাঝে শিখর ধাওয়ান ইনজুরি বাঁধিয়ে টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যান। টিম ইন্ডিয়া পড়ে মহাবিপদে- ধাওয়ান রোহিত জুটি ছাড়া আর মুক্তি কি আছে ভারতের?
হ্যা, মুক্তি আছে। ভারতের সেই মুক্তির নাম লোকেশ রাহুল। এমনিতে ব্যাট করছিলেন নিচের দিকে, বিশ্বকাপের আগে রাহুলকে নেওয়াও হয়েছিল নিচের দিকে ব্যাট করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখার শর্তে। রাহুলও যখন তাতে তৈরি, সেসময় হঠাৎই রাহুলকে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তা তিনি কিন্তু তাতে খারাপ করেননি। ওপেনিংয়ে নেমে বাকি ম্যাচগুলিতে রাহুলের রান ৫৭, ৩০,৪৮, ০,৭৭,১১১ আর ১!
এমনিতে আইসিসির মঞ্চে শিখর ধাওয়ানকে টপকানোর সাধ্য কারো নেই, অভাব পূরণের তো নয়ই। তবে, ধাওয়ানের জায়গায় খেলতে নেমে ৪৭ এর কাছাকাছি গড়ে রাহুলের এই রান নেহায়েৎ মন্দ নয়। আর লোয়ার অর্ডারে খেলার মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া কারো হুট করে ওপেনিংয়ে নেমে এমন টুর্নামেন্টে এমন রান তো আরো ভাল।
লোকেশ রাহুল আসলে যাকে বলে একজন টিমম্যান। তিনি দলের চাহিদা মেনে খেলতে পারেন পুরোপুরি। ধোনি দলে নেই? রাহুলের খোজ পড়ে? তিনে বিরাট নেই? রাহুলের খোঁজ পড়ে। ওপেনিংয়ে কেউ ইনজুরিতে? রাহুলের খোঁজ পড়ে। লোকেশ রাহুল বারবারই আসেন, কখনও পারেন কখনও পারেন না। কিন্তু কোন এক কারণে তিনি খুব বেশি আলোয় থাকেন না, দলই থাকতে দেয়না।
এই যে মেলবোর্ন টেস্টের কথাই ধরা যাক। ওপেনিংয়ে রদবদল আনতে হলে ভাবা হচ্ছিল, লোকেশ রাহুলকে এবার সুযোগ দেওয়া হবে, যেখানে দলে কোহলিও নেই। কিন্তু, তাতেও রাহুলের সুযোগ মেলেনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৭৮ ম্যাচে তিনি করেছেন ৫৮০২ রান, গড় ৪৬.০৪। সিনিয়রদের অনুপস্থিতিতে রাহুলকে দলে নেওয়ার জন্যে যোগ্য পরিসংখ্যান বলা চলে। কিন্তু নাহ, তাতেও কিন্তু মেলেনি সুযোগ!
কিন্তু তাতেই বা কি। রাহুল কিন্তু হাল ছাড়বেন না।