অনন্তকালের অপেক্ষা নয়, তবে এ দীর্ঘ অপেক্ষা যেন এক প্রকার ধৈর্যচ্যুতিই ঘটিয়েছিল। সাদা পোশাকে বিরাট কোহলি যে বহু দিন ধরেই বড্ড সাদামাটা। সেই ২০১৯ সালে শেষ বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন, এরপর আর টেস্টে কোনো শতকের দেখা নেই।
সেদিন সাদা পোশাকের সেঞ্চুরি সংখ্যায় ২৭ সংখ্যাটা যখন বিরাট ছুঁয়েছিলেন, তখন কি তিনি আদৌ ভেবেছিলেন ২৮ নম্বর সেঞ্চুরিটা পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে ১২০৫ টা দিন? বোধহয়, না।
সেঞ্চুরি করা তখন বিরাটের নিত্যদিনের চিত্র। শচীনের শত সেঞ্চুরির রেকর্ডও তখন এক প্রকার আ-শঙ্কাপূর্ণ অবস্থায়। কিন্তু সেই কোহলিই সেঞ্চুরি করা ভুলে গেলেন। দিন পেরিয়ে মাস গড়ালো, মাস পেরিয়ে বছর। কোহলির ব্যাটে সেঞ্চুরি আসে না। করোনায় থেমে যাওয়া পৃথিবীর মতো কোহলির সেঞ্চুরিযাত্রাও থেমে গেল।
বিরাট আবারো সেঞ্চুরিতে ফিরেছিলেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে, এশিয়া কাপে। তবে সেটা ছিল বিশ ওভারের ক্রিকেট। ওয়ানডেতেও সেঞ্চুরি খরা কাটালেন এর কয়েক মাস বাদেই। তবে সাদা পোশাকে ‘২৭’ সংখ্যাকে কোনোভাবে ‘২৮’ এ নিয়েই যেতে পারছিলেন না। অবশেষে ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আহমেদাবাদ টেস্টে সেই অপেক্ষা এবার ফুরোলো। ২৩ টেস্ট পর আবারো সেঞ্চুরি পেলেন বিরাট কোহলি।
দীর্ঘ সময় পর সেঞ্চুরি। অপেক্ষাটা বোধহয় পেয়ে বসেছিল স্বয়ং বিরাট কোহলিকেই। হবেই বা না কেন? বিরাট কোহলি তো বাইশ গজে নিজের অবনমন দেখায় অভ্যস্ত নন। কিন্তু এই তিনটা বছর বিরাট কোহলিকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। তাঁর সম সাময়িক জো রুট, স্টিভ স্মিথরা এক সময় পিছিয়ে থেকেও এই সময়ের মধ্যে এগিয়ে গিয়েছেন। একই সাথে বাবর আজম, কেন উইলিয়ামসরাও দুরন্ত গতিতে এগিয়েছেন এই লঙ্গার ফরম্যাটে। পিছনে পড়েছিলেন শুধুই বিরাট।
সেই বিরাট কোহলি অবশেষে সেঞ্চুরি খরা কাটালেন। অপয়া ‘২৭’ থেকে অন্তত মুক্তি পেলেন। তবে সেঞ্চুরিটা যখন পেলেন তখন বিরাটের মধ্যে যেন কোনো উচ্ছ্বাসই নেই। দু’হাত প্রসারিত করে আকাশমুখে তাঁকালেন। এরপর নিজের গলায় থাকা লকেটে চুমু খেলেন। সম্ভবত সেঞ্চুরির এই দীর্ঘ খরা বিরাটকেও ভাবিয়ে তুলেছিল। নিজের আত্মবিশ্বাসে একটা ভঙ্গুরতা সৃষ্টি করেছিল। তাই উচ্ছ্বাস কিংবা তৃপ্ততা নয়, একটা আটকে থাকা জাল থেকে মুক্তির দীর্ঘশ্বাসই যেন বেরিয়ে আসছিল চেহারায়।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিরাটের সেঞ্চুরি মোটেই নতুন কিছু নয়। আহমেদাবাদ টেস্টের আগেও অজিদের বিপক্ষে ৭ টি সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। তবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম আর এই অষ্টম সেঞ্চুরির মাঝে দারুণ এক সাদৃশ্যতা আছে। বিরাট কোহলির ক্যারিয়ারের শুরুর দিককার কথা।
ওয়ানডে ফরম্যাটে দারুণ ফর্ম তাঁকে জায়গা পাইয়ে দিল টেস্টেও। কিন্তু এই ফরম্যাটে এসেই কোহলির ভিন্ন রূপ। নিজেকে শুরুর দিকে খুঁজেই পাচ্ছিলেন না। ভারতে তখন বিরাটকে নিয়ে সরগরম। ক্রমাগত বাজে ফর্মের কারণে টেস্ট দলে সে সময়ে কোহলিকে চাচ্ছিলেন না কেউই।
তবে মহেন্দ্র সিং ধোনি ঠিকই বিরাটের উপর ভরসা রাখলেন। ২০১২ সালে কোহলিকে দলে রেখেই গেলেন অস্ট্রেলিয়া সফরে। আর ঐ সফরেই এডিলেড টেস্টে সেঞ্চুরি করে টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নেন কোহলি। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ওয়ানডে ক্রিকেটের মতো বিরাট কোহলি টেস্ট ক্রিকেটেও নিজেকে নিয়ে যান চূড়ায়।
সেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই আবারো সেঞ্চুরি করে সেঞ্চুরি খরা কাটালেন কোহলি। তবে কি সাদা পোশাকে বিরাট কোহলির একটা নতুন শুরু হতে চলেছে? সেটা অবশ্য সময়ই বলে দিবে। তবে আহমেদাবাদ টেস্টে বিরাট কোহলি সেঞ্চুরি করলেন একদম মোক্ষম সময়ে।
প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ৪৮০ রানের চাপ নিয়ে যেভাবে ক্রিজে সময় কাটিয়ে সেঞ্চুরি করলেন তা এক কথায় অনবদ্য। সেঞ্চুরির পর ডাবল সেঞ্চুরির পথেও হেঁটেছিলেন কোহলি। তবে শেষ পর্যন্ত থেমেছেন ১৮৬ রানে। আর কোহলির এমন দুর্দান্ত ইনিংসের কল্যাণেই ৯১ রানের লিড পেয়েছে ভারত।
টেস্টে ২৮ নম্বর সেঞ্চুরি, সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭৫ তম শতক। বর্তমানের ক্রিকেটে খেলছেন এমন একজন ব্যাটারেরও ৫০ টা সেঞ্চুরি নেই। সেখানে কোহলি একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন বছর তিনেক আগেই। মাঝ খানে একটা বিরতি।
এই বিরতিই পারতো বিরাট কোহলির পাশে ‘শেষ’ তকমা বসাতে। কিন্তু দুর্দান্ত আগ্রাসনে যিনি প্রায় এক দশক ধরে ব্যাট হাতে বাইশ গজ শাসন করেছেন তিনি কেন থামবেন? কেনই বা তাঁর নিন্দুকদের জিততে দিবেন? বাইশ গজের ব্যাট হাতে বিজয়োল্লাস তো তাঁর রন্ধ্রে।
বিরাট কোহলির সেই বিজয়োল্লাসও আবার ফেরার পথে। ওয়ানডে ক্রিকেটে সাফল্যযাত্রা শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। এই ধারা টেনে এনেছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও। এবার পালা সেই প্রবাহ টেস্ট ক্রিকেটেও ফিরিয়ে আনা। আপাতত এক সেঞ্চুরি দিয়ে শুরু করলেন। এখন দেখার পালা, এই চিত্রটা কতটা সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে পারেন কোহলি।