বেসিন রিজার্ভ থেকে হ্যাগলি ওভাল, কিউইরা বিজয়োল্লাস করেছে দুই টেস্টেই। তবে জয় দুটি এসেছে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, সমর্থকদের নখ কামড়ানো অসংখ্য রোমাঞ্চকর মুহূর্তের অবতারণায়।
কে বলেছে, টেস্ট ক্রিকেট মৃতপ্রায়! তাহলে নিউজিল্যান্ডের শেষ দুটি টেস্টের দৃশ্যপটে ফিরে যান। এক মুহূর্ত চোখ সরানোর যেন উপায় নেই। বেসিন রিজার্ভে ইংলিশদের বিপক্ষে জয় এসেছিল মাত্র এক উইকেটে। আর এবার হ্যাগলি ওভালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় আসলো ম্যাচের শেষ বলে।
ভিন্ন প্রতিপক্ষ, অভিন্ন বিজয়ী দল – নিউজিল্যান্ড। তবে এর মাঝে আরো একটি ব্যাপারও ধ্রুব। নিউজিল্যান্ডকে এ দুই টেস্টেই ম্যাচে ফিরিয়েছেন অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। বেসিন রিজার্ভে ইংলিশদের বিপক্ষে ফলোয়নে পড়ে কেন উইলিয়ামসনের ১৩২ রানের ইনিংসেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল কিউইরা। আর এবার লঙ্কানদের বিপক্ষে প্রায় ড্র’য়ের পথে এগিয়ে যাওয়া ম্যাচটা কিউইরা জিতল সেই কেনের ইনিংসের উপর ভর করেই। এবারও কেন উইলিয়ামসনের ব্যাটে সেঞ্চুরি।
টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি। আগের দুই বছরে যে কটা সেঞ্চুরি নামের পাশে লিখিয়েছিলেন, তা করলেন এই দুই টেস্টেই। সব মিলিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ারে নিজের ২৭ তম সেঞ্চুরি তুলে নিলেন এ কিউই ব্যাটার।
বরাবরই কেন উইলিয়ামসনের পরিচিতি একজন ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের ব্যাটার হিসেবে। রান পাওয়ায় খুব তাড়াহুড়ো নেই, বোলারদের আগ্রাসনে তেমন জবাব নেই, শুধু ক্রিকেটের ব্যকরণ মেনে উইকেটে সময় কাটিয়ে দেন। লাল বলের ক্রিকেটে এ কিউই ব্যাটারের ধরণটা ঠিক এমনই। তবে হ্যাগলি ওভালে লঙ্কানদের বিপক্ষে ব্যাট হাতে এতটা ভদ্রস্থ হয়ে ব্যাটিং করলে ফলাফল শূন্যের পথেই ছিল। কারণ ম্যাচ জয়ের পথে সমীকরণটা যে অতটাও সহজ ছিল না।
৭০ ওভারে করতে হবে ২৮৫ রান। চারের উপরে রান রেট, সাথে উইকেট টিকিয়ে রেখে টেস্ট ক্রিকেটে এমন লক্ষ্য তাড়া করা মোটেই সহজ কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু এমন এক সমীকরণের ম্যাচ ড্র করার পথেই বা কোন দল হাঁটবে? ব্যাপারটা অনেকটা ডু অর ডাই-এর তো। কিউইরা ম্যাচ জয়ের লক্ষ্যেই শেষ ইনিংসে ব্যাট করতে শুরু করলো। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি। ৫০ রানের মাঝে দুই ওপেনারের বিদায়। এরপর দলীয় ৯০ রানে আরেকটি উইকেটের পতন।
এমন এক পরিস্থিতি থেকে ড্র’য়ের পথে পা বাড়ানোই শ্রেয়। অন্তত তো পরাজয় তো এড়ানো যাবে। কিন্তু কিউই অধিনায়ক আগের পরিকল্পনাতেই অটল থাকলেন। ড্যারিল মিশেলকে নিয়ে লম্বা একটা জুটি গড়লেন। দুজনের যুগলবন্দীতে ড্যারিল মিশেলই বেশি হাত খুলে খেলছিলেন। একই সাথে অপর প্রান্তে কেন উইলিয়ামসনও নিজের রানের গতি বাড়াচ্ছিলেন। ডান হাতি এ দুই ব্যাটারের দারুণ পরিকল্পনায় জয়ের পথেই এগোচ্ছিল কিউইরা।
কিন্তু ম্যাচের শেষ রোমাঞ্চ তো তখনও বাকি। ড্যারিল মিশেল ততক্ষণে ব্যক্তিগত ৮১ রানে ফিরে গিয়েছেন। কেন উইলিয়ামসন অবশ্য সেঞ্চুরি তুলে নিতে ভুল করেননি। কিন্তু সেখানেই তো দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। ম্যাচের শেষ ওভারে জটিল এক সমীকরণের মুখে পড়ে যান এ কিউই অধিনায়ক। নিউজিল্যান্ডকে ম্যাচ জিততে হলে শেষ ৩ বলে তুলতে হবে ৫ রান। টেস্টে ক্রিকেটের মাঝে তখন অনেকটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আমেজ।
আসিথা ফার্নান্দোর করা ঠিক পরের বলেই চার মারেন কেন উইলিয়ামসন। ম্যাচ তখনই ঝুঁকে গিয়েছে নিউজিল্যান্ডের দিকে। কিন্তু চূড়ান্ত নাটকীয়তা তো জমে ছিল শেষ দুই বলে। ফার্নান্দোর পরে বলে বাউন্সারের কারণে ব্যাটে বলে করতে পারলেন না উইলিয়ামসন। এমন কি শেষ বলটাতেও ব্যাটে লাগাতে ব্যর্থ হলেন।
কিন্তু কী আর করা! ম্যাচ জয়ের জন্য ঐ একটা রান যে তার লাগবেই। উইকেটরক্ষকের কাছে বল যেতেই দিলে ভো দৌড়। নন স্ট্রাইক প্রান্তে পৌঁছেও গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আবার লঙ্কান উইকেট রক্ষক থেকে বল নিয়ে ফার্নান্দোর ডিরেক্ট থ্রোতে স্ট্যাম্প ছত্রখান। লঙ্কানরা তখন প্রায় উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু টিভি রিপ্লেতে দেখা গেল, দুর্দান্ত ডাইভ দিয়ে স্ট্যাম্প ভাঙ্গার আগেই অপর প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছেন কেন উইলিয়ামসন। অর্থাৎ জয়টা নিউজিল্যান্ডের।
টেস্ট ক্রিকেটের একটা ফলের অপেক্ষায় জায়ান্ট স্ক্রিনে সবাইকে তাকিয়ে থাকতে হলো, এমন মুহূর্ত টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে ক’বারই ঘটেছে। এমন দৃশ্যের নমুনা নেই বললেই চলে। তবে হ্যাগলি ওভাল সেই বিরল মুহূর্তেরই জন্ম দিল।
কেন উইলিয়ামসনের ১৯৪ বলে ১২১ রানের ইনিংসটা টেস্ট ক্রিকেটের মানদণ্ডে আর দশটা ইনিংসের মতোই সাধারণ। অহরহ সেঞ্চুরির ভিড়ে এই সেঞ্চুরিটাকে আলাদা করার বিশেষ কারণ নাই বা থাকতে পারে। এই ইনিংস বাদে কেন উইলিয়ামসন আরো ২৬ টা সেঞ্চুরি করেছেন। ৫ টা ডাবল সেঞ্চুরিও করেছেন। কিন্তু এই ইনিংসটা কেন উইলিয়ামসনের ক্যারিয়ারে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায়।
দলের সাময়িক বিপদ ঠেলে যেভাবে ব্যাট তিনি করেছেন তা এক কথায় দুর্দান্ত। ম্যাচের টেম্পারমেন্ট ধরে রেখেছেন শেষ পর্যন্ত। রান রেটের ধাক্কা ছিল। কিন্তু কখনোই ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি তাঁর ব্যাটে। সাবলীলভাবে ব্যাট করে গিয়েছেন ইনিংসের শেষ পর্যন্ত।
এমন ইনিংস অবশ্য আরো রঙ যোগ করেছে ম্যাচ জেতার কারণে। তারপরও এই ইনিংস অন্তত কেন উইলিয়ামসনের ক্যারিয়ারে আর দশটা শতকের চেয়ে নি:সন্দেহে এগিয়ে থাকেব। সাদা পোশাকে কেন উইলিয়ামসনের এ যেন শুভ্রতায় মোড়ানো এক ইনিংস।
মজার ব্যাপার হলো, যে প্রাণপণ দৌড় আর ডাইভ দিয়ে নিউজিল্যান্ডকে ম্যাচ জেতালেন কেন উইলিয়ামসন, সেই রানটি আবার ক্যারিয়ারের খাতায় যোগই হবে না। ক্রিকেটের মাহাত্ম্যটা যেন এখানেই। ব্যক্তিগত অর্জন, কিংবা পরিসংখ্যান- সব কিছুর ঊর্ধ্বে দল। দলের সফলতাতেই একজন ক্রিকেটারের সিংহভাগ অর্জন সমৃদ্ধ হয়, রঙিন হয় তাঁর ক্যারিয়ার। কেন উইলিয়ামসন সেই সব বিবেচনায় দ্বিধাহীনভাবেই সাদা পোশাকের একজন রঙিন ক্রিকেটার।