সাকিব, মোর দ্যান আ পারফর্মার

না। তিন অঙ্কের ম্যাজিকাল ফিগার ছোঁয়া হয়নি। নার্ভাস নাইন্টি নামক দুর্ভাগ্যের চক্করে পড়েছেন। তাতে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা সেঞ্চুরির সংখ্যা ৯ থেকে আর ১০-এ রূপ নেয়নি। তবে এতগুলো ‘না পাওয়া’র মাঝে বাংলাদেশ দলকে ঠিকই বড় সংগ্রহের পথে এগিয়ে দিয়েছেন।

সাকিবের ধরনটাই বোধহয় এমন। ক্যারিয়ারে মুড়ি মুড়কির মতো রেকর্ড গড়েছেন। তাঁর কাছে এমন সেঞ্চুরি মিসের অপ্রাপ্তি, আর এমন কী! সেঞ্চুরি মিসের দিনেও তো ঠিকই রেকর্ড গড়েছেন। এই যেমন ওয়ানডে ক্রিকেটে সাত হাজারি রানের ক্লাবে আজই প্রবেশ করলেন।

ওয়ানডে ক্রিকেটে ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ৭০০০ রান করেছেন ৪৪ জন ব্যাটার। আর বল হাতে ৩০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন ১৪ জন বোলার। আর এই দুটিই করেছেন মাত্র ৩ জন অলরাউন্ডার! সেই ছোট্ট তালিকাটায় সর্বশেষ সংযোজন সাকিব আল হাসান। সনাথ জয়াসুরিয়া, শহীদ আফ্রিদির পর তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ৭০০০ রান আর ৩০০ উইকেটের অনন্য মাইলফলকে নাম লেখালেন বাংলার ক্রিকেটের এ নবাব।

হ্যাঁ। তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে রেকর্ডটা করলেন বটে। তবে অন্য দুজনের চেয়ে সেটি দ্রুততম সময়ে। মাত্র ২২৮ টি ম্যাচ খেললেন জয়াসুরিয়া, আফ্রিদিদের পাশে নাম লেখাতে।

এবার আসা যাক তাঁর খেলা ৯৩ রানের ইনিংসে। রেকর্ডকথন তো অনেকখানি হলো। রেকর্ডের সাথে সাকিবের সখ্যতা ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। ক্রিকেট ইতিহাসের মানদন্ডে যা অতি দুর্দান্ত, সেটাই যেন সাকিব স্বাভাবিক বলয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। একই ভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে যা সব ইতিহাস, ঐতিহ্য মেনে চলে তার যেন তোয়াক্কাই করেন না সাকিব।

কিভাবে? সাকিবের ব্যক্তিগত সংগ্রহ তখন ছুটছে শতকের দিকে। তবে সাকিবের বোধোদয়ে দলের রানের গতিই যে তখন মুখ্য। তাই শুরুতে ইনিংস যেভাবে শুরু করেছিলেন, তার চেয়েও আগ্রাসী ভূমিকায় ব্যাট করলেন ব্যক্তিগত ৮০/৯০ রানের সময়ে।

ফলাফল, সেঞ্চুরি থেকে ৭ রান দূরে থাকতেই সাকিব আউট হয়ে ফিরে গেলেন। সাকিবের সেঞ্চুরি মিসে তখন গ্যালারি হতাশায় ঝেঁকে বসেছে। কিছুটা হতাশ হয়তো সাকিবও ছিলেন। কিন্তু ঐ যে দলকে দারুণ অবস্থায় রেখে ফিরে গেলেন, ওখানেই যেন সাকিবের তৃপ্ততা।

একজন ক্রিকেটারের বছর তিনেক ধরে সেঞ্চুরি নেই। চাইলেই সেখান থেকে ব্যক্তিগত অর্জনের দিকে চোখ রাখতে পারতেন। কিন্তু না। কিছুটা আলগোছে প্রকৃতি, নিয়মের তোয়াক্কা না করেই নিজের ইনিংস নিয়ে ছুটেছেন সাকিব। বোলারদের মনসংযোগে আঘাত করেছেন। আর তাতেই বড় এক সংগ্রহের টোটকা পেয়ে যায় বাংলাদেশ।

অথচ, সাকিব যখন ক্রিজে এসেছিলেন তখন ৫ এর নিচে রানরেটে কিছুটা ধুঁকছে বাংলাদেশ। ১০০ এর আগেই বিদায় টপ অর্ডারদের। এমন পরিস্থিতিতে আইরিশরা তখন বাংলাদেশকে চেপে ধরার স্বপ্নেই চোখ রাখছিল।

কিন্তু, সাকিব সেসব নস্যাৎ করে দেন কিছুক্ষণ বাদেই। প্রথমে সাময়িক চাপ থেকে দলকে বের করে নিয়ে আসেন। এরপর প্রতিপক্ষদের উপর পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করেন। অবশ্য সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছিলেন অভিষিক্ত ক্রিকেটার তৌহিদ হৃদয়কে। দুজনের ১৩৫ রানের জুটিতে চালকের আসনে উঠে যায় বাংলাদেশ।

৯ চারে ৮৯ বলে সাকিবের ঝলমলে ৯৩ রানের ইনিংস। দুর্দান্ত এ ইনিংস খেলার পথে সাকিব গিয়ার পাল্টেছেন মোক্ষম সময়ে। অর্ধশতক পূরণ করেছিলেন মন্থর গতিতেই, ৬৫ বলে। কিন্তু ইনিংসের পরের ৪৩ রান করতে বল হজম করেছেন মাত্র ২৪ টি। সাকিব মূলত নিজের আক্রমণাত্বক মেজাজের মোমেন্টাম পেয়েছিলেন হ্যারি টেক্টরের ওভারে।

ইনিংসের ৩৫ তম ওভারের এ স্পিনারের এক ওভারেই সাকিব মারেন ৪ টি চার। আর ওতেই বাংলাদেশের ইনিংসে দুর্দান্ত একটা গতি আসে। সেটা অব্যাহত ছিল ইনিংসের শেষ পর্যন্ত।

২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকে সাকিবের ব্যাট থেকে কোনো সেঞ্চুরি আসেনি। এমন পরিসংখ্যান অবশ্যই হতাশার পাল্লা ভারি করতে পারে। কিন্তু সাকিব যেন এই সব মানদন্ডের ঊর্ধ্বেও বিশেষ কিছু। যেখানে হয়তো ‘সংখ্যা’ নামক পরিসংখ্যানের আধিক্যে সমৃদ্ধ হচ্ছেন না। কিন্তু দলের চেহারা বদলের নায়করূপে আবির্ভূত হচ্ছেন। একজন ক্রিকেটারের জন্য সেটিই তো পরম পাওয়ার বিষয়।

সাকিবে দলের স্বার্থে ঝুঁকি নিয়েছেন, দলের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছেন। এমন সাকিব কি শুধু ‘পারফর্মার’ বিশেষণেই বিশেষায়িত হবেন? না। সাকিব সম্ভবত মোর দ্যান আ পারফর্মার।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link