ফুটবলের প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ

‘তোমাতেই যেন সঁপিয়াছি সব,

ছিটিয়েছি যতো প্রেম;

তোমার আঁচলে হয়েছে বন্দী

এক জীবনের ফ্রেম…।’

গল্পটা কিংবদন্তী ফুটবল কোচ স্যার এলেক্স ফার্গুসনের; কবিতার চরণগুলো যেন এই মানুষটির পুরো জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রেড ডেভিলদের সাফল্যের এক অনন্য কারিগর ফার্গগুসনকে চেনেনা এমন কোনো ফুটবলপ্রেমী পৃথিবীতে নেই। এই মানুষটিতেই যেনো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ভক্তরা নিজেদের সপে দিয়েছিলো। তাইতো ফার্গির জীবন্ত রূপকথার গল্পেই সাজবে আজ বছর শেষের ডায়েরি।

সময়টা ১৯৮৬ সালের শেষের দিকের।

বিধ্বস্ত ইউনাইটেড ছেড়ে দিলেন তৎকালীন কোচ রন অ্যাটকিনসন। দলে নতুন কোচ হিসেবে দায়িত্ব পেলেন ৪৪ বছর বয়সী ফার্গুসন। লিগ টেবিলের ২২ দলের মধ্যে রেড ডেভিলদের অবস্থান তখন ২১তম। কোচ হিসেবে আসার পরে এমন অবস্থা দেখলে সমস্যার হিমালয়ে সম্ভাবনা নামক শব্দটি বরফচাপা হয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

দলের তারকা খেলোয়াড়েরা মদ্যপ আর তীব্র হতাশায় জর্জরিত। খেলোয়াড় ট্রান্সফার করার মতো নেই পর্যাপ্ত অর্থ। তাহলে কিসের বলে ক্লাবের উন্নতি সাধন করবেন তিনি!

নাহ, হাল ছাড়েননি ফার্গি; ধ্বংস থেকে টেনে তোলার অদম্য শক্তি নিয়েই শুরু করেন কাজ। ২১ নম্বর পজিশনে থাকা ম্যান ইউ শেষ পর্যন্ত এই সিজন শেষ করে ১১ নম্বরে থেকে।

ইউনাইটেডে এসে ফার্গুসন বেশ ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিলেন, জাদুকরী ছোঁয়ায় এই দলের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি ভবিষ্যতের জন্য দলের খুঁটি শক্ত করতে লেগে পড়লেন কাজে। প্রথমেই যে কাজটি করেন তা হলো প্রত্যেকের নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ। এর ফলশ্রুতিতে পরবর্তী সিজনেই (১৯৮৭-৮৮) দ্বিতীয় হয় তার দল। কিন্তু কণ্টকাকীর্ণ এ পথ অতোটা সহজ ছিলোনা। আবারও নিচের দিকে নামতে থাকে দলের পজিশন। সেই সাথে অনিশ্চিত হয়ে যায় ফার্গির কোচিং ক্যারিয়ার। কিন্তু প্রবাদে আছে, ‘পরিশ্রম কখনও বৃথা যায়না।’ সেটিই বাস্তব হয়ে যায় তার জীবনেও।

ইংলিশ এফএ কাপে দূর্দান্ত ফর্মে থাকা নটিংহ্যাম ফরেস্টকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেয় ফার্গুসন শিষ্যরা। শুধু তাই নয়, সেই মৌসুমে এফএ কাপ শিরোপাও জিতেছিলো ম্যান ইউ। পরের বছর উইনার্স কাপের ফাইনালে বার্সাকে হারিয়ে নিজের মুন্সিয়ানার প্রমাণ ধীরে ধীরে দেয়া শুরু করেন ফার্গি।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে প্রথম লিগ শিরোপা জিতেন তিনি। ১৯৬৭ সালের পরে সেটিই ছিলো প্রথম শিরোপা। ম্যান ইউ’র প্রত্যাবর্তনের এই সিজনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা এস্টন ভিলার চেয়ে ১০ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে লিগ শেষ করেছিলো রেড ডেভিলরা। এরপরে আর পিছন ফিরতে হয়নি এই মহানায়ককে। পাঁচ বছরের মধ্যে চার চারবার লিগ জয়ের অনন্য কৃতিত্ব গড়েন ফার্গুসন। ব্যার্থতার অন্ধকারে মুড়ে থাকা একটা দলকে সফলতায় প্রজ্জ্বলিত করার এমন অনবদ্য শৈলী এখনও ফুটবল বিশ্বের কাছে বিস্ময়করই বটে।

১৯৯৮-৯৯ সিজনে নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্যের দেখা পান ফার্গি। সেবার প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে ট্রেবল জয়ের স্বাদ পায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। এই সাফল্যের বদৌলতে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের নিকট নাইটহুড উপাধি পান এলেক্স ফার্গুসন। এর ফলেই তার নামের আগে সম্মানসূচক ‘স্যার’ উপাধি সংযুক্ত হয়। সেই থেকেই তিনি বনে যান ‘স্যার এলেক্স ফার্গুসন।’

ক্যারিয়ারে চ্যালেঞ্জ খুব উপভোগ করেছেন ফার্গুসন। সময়ের সাথে নিজেকেও মানিয়ে নিয়েছেন চিরচেনা রূপে। ১৯৯৯-২০০২ পর্যন্ত হ্যাট্রিক লিগ জেতার পরে যখন এক এক করে সিনিয়র খেলোয়াড়েরা দল ছাড়ছিলো তখন আবার তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দূর্গ সামলাতে। এই মিশন থেকেই তিনি আবিষ্কার করেন এক ঝাঁক নতুন তারকা। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, ওয়েইন রুনি, পার্ক জি সুং, প্যাট্রিক এভরাদের মতো তরুণদের ভিন্ন ভিন্ন যায়গা থেকে তুলে এনে  দলে ভিড়িয়েছিলেন ফার্গি।

পরীক্ষায় মোটেই হতাশ হননি, এই নতুনদের জাদুকরী ফুটবলে অন্য এক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড উপহার পেয়েছিলেন তিনি। এ যেন আরও গতিশীল, আরও পরিণত এক শক্তিধর দল। ২০০৬-০৭ সিজনে তরুণদের গতিকে কাজে লাগিয়েই জিতেছেন নবম লিগ টাইটেল।

২০০৭-০৮ সিজনে ম্যান ইউয়ের হয়ে দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টাইটেল জেতেন স্যার এলেক্স ফার্গুসন। পরেরবারও দলকে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন তিনি। ২০০৯-১০ সিজনে প্রিমিয়ার লিগ জিতে ইংলিশ লীগের সবচাইতে সফলতম দলের কৃতিত্ব গড়েছিলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। সেই সিজন চলাকালীনই এক ক্লাবের হয়ে সবচাইতে বেশিদিন ম্যানেজার থাকার রেকর্ড গড়েন ফার্গি। নিজের কাছে নিজের যে প্রত্যাশা ছিলো তার সবটুকুই যেন পূর্ণতা পায়। ২০১২-১৩ সিজনে নিজের ২০তম টাইটেল জিতে অবসরে যান এই কিংবদন্তী।

১৯৪১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে দাদীর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন স্যার এলেক্স ফার্গুসন। বাবা আলেক্সান্দার বিটন ফার্গুসন ও মা এলিজাবেথ ফার্গুসনের বড় সন্তান এলেক্সের শৈশব কাটে শীপ বিল্ডিং কমিউনিটিতে। ছোট থেকেই আর দশজন শিশুর মতো ছিলেন না তিনি। তিনি প্রচুর মেধাবী ছিলেন কিন্তু সেই মেধার ঈষৎ ব্যয় করেছেন পড়ালেখায়, বাকি সবটুকুই শুধু ফুটবলের জন্য। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া ফার্গি তার প্রথম জীবনে পেয়েছেন বাবার পূর্ণ সমর্থন। এর জেরেই নিজের কাঙ্খিত মসনদে পৌছাতে পেরেছিলেন এই মহানায়ক।

শুধু ক্যারিয়ার নয়, ব্যক্তি জীবনেও ফার্গুসন ছিলেন অত্যন্ত সফল। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে বেশ সুখী একটা জীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন তিনি। পরিবার সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিবার শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়, জীবনের সবকিছুই হলো পরিবার।

কোচিং ক্যারিয়ারে ‘দ্য বস’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন ফার্গি। কড়াভাবে যেমন শাসন করেছেন খেলোয়াড়দের, ঠিক তেমন করেই বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন পরম মমতায়। খেলোয়াড় গড়ার জাদুকর ছিলেন তিনি। কারণ তিনি কখনও বড় বড় খেলোয়াড় কেনার পেছনে অর্থ ব্যয় করেননি, বরং তার তৈরী করা খেলোয়াড়রাই হয়েছে মেগাস্টার। চৌদ্দশোরও বেশি ম্যাচে ডাগআউটে দাঁড়ানো ফার্গুসন সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে মাত্র তিনটি ম্যাচ মিস করেছিলেন। এটাও এক অনন্য রেকর্ড।

কোচ হিসেবে অনবদ্য শৈল্পিক ফার্গুসন খেলোয়াড়ী জীবনেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন। স্কটল্যান্ডের শীর্ষ ক্লাবগুলোর হয়ে ১৭১ টি গোল করেছেন তিনি তার খেলোয়াড়ী ক্যারিয়ারে।

২০১৩ সালে অবসরের ঘোষণার সময় ম্যান ইউ’র আলমারিতে ৩৮টি ট্রফি সাজিয়ে দিয়ে গেছেন স্যার এলেক্স ফার্গুসন। ব্যক্তিগত অর্জনে তার ধারেকাছেও কেউ নেই। তার নামে ওল্ড ট্রাফোর্ডে  নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তা, স্থাপন করা হয়েছে বিশাল এক মূর্তি। এমনকি একটি গ্যালারিরও নামকরন করা হয়েছে ‘স্যার এলেক্স ফার্গুসন’ নামে।

শুধুমাত্র ট্রফির বিচারে কিংবা মুন্সিয়ানায় শ্রেষ্ঠ নন ফার্গি, একজন অদম্য মানুষ হিসেবেই তিনি সবচাইতে বেশি সফল। নানা চড়াই-উৎরাই, অর্থলোভ কিংবা বিচ্ছিন্ন ঘটনা; কোনোকিছুই এতোটুকুও দমাতে পারেনি তাকে। ক্লাবের প্রতি তুমুল প্রেমের টানে তিনি শূন্য থেকেই রচনা করেছেন স্বপ্নীল এক রূপকথা। জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে সাজানো দলটিও তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে ভালোবাসার সৌরভটুকু। ভালোবাসা, আত্মত্যাগ আর কৌশল; স্যার এলেক্স ফার্গুসনের এই চিরসবুজ কাব্যগাথা আজীবন আদর্শ হয়ে থাকবে ফুটবল বিশ্বে।

লেখক পরিচিতি

আকাশমুখো দুরন্ত মেঘেদের গল্প লিখার আশ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link