ঘড়ির কাঁটা ঘুরেছে, সময় পাল্টেছে। সময়ের প্রবাহমান এমন ধারায় অনেকগুলো দিন, মাস, বছর পেরিয়ে পৃথিবী যুগান্তরগামী হয়েছে। সেই হিসেবে, একবিংশ শতাব্দীর পা পড়েছে তিনটা ভিন্ন দশকে। এমন ভিন্ন ভিন্ন দশকে বাইশ গজের ময়দানে কত কিছুই না পাল্টে গিয়েছে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হাত বদল হয়েছে উত্তরসূরির ব্যাটন।
ঝিমিয়ে যাওয়া টেস্ট ক্রিকেট পাল্টে গিয়ে রূপ নিয়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে। টেস্টের সাদা জার্সিতে বসেছে জার্সি নাম্বার। কিন্তু এতসব পরিবর্তনের তীব্র স্রোতের মাঝেও একজন যেন সেই স্রোতের বিপরীত বৃত্তে থেকে গিয়েছেন। তিনি সাকিব আল হাসান।
সময়টা তখন ২০০৯। ওয়ানডে ক্রিকেটে তখন ব্যাটে বলে-অলরাউন্ড নৈপুণ্যে সমানে রাজত্ব দেখিয়ে যাচ্ছিলেন অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, যুবরাজ সিং, জ্যাকব ওরামরা। এমন সব তারকাদের মাঝে সেরার লড়াইয়ে হঠাতই চলে আসলেন একজন বাংলাদেশি। নাম সাকিব আল হাসান।
তো ৭৫ নম্বর জার্সিধারী ২১ বছর বয়সী টগবগে সেই তরুণ ক্রিকেটার প্রথমে জ্যাক ওরামকে টপকালেন, এরপর যুবরাজ সিং, ফ্লিনটফদেরও সেরার লড়াইয়ে টপকে গেলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে সেরা অলরাউন্ডদের তালিকার শীর্ষ আসনটায় পদচিহ্ন পড়লো প্রথম কোনো বাংলাদেশির। সেই যে সাকিব রাজত্ব শুরু হলো। এরপর তা চলতে থাকল বছরের পর বছর। ওয়ানডের পাশাপাশি, টেস্ট , টি-টোয়েন্টিতেও নিজেকে নিয়ে গেলেন একক রাজত্বের সিংহাসনে।
সময়টা এখন ২০২৩। সে সময়ের ২১ বছর বয়সী সাকিব এখন পেড়িয়েছেন ৩৫ এর কোঠা। সেই তারুণ্যের উদ্দামে ভরপুর সাকিব এখন ক্যারিয়ার সায়াহ্নে। কিন্তু সাকিব যেন তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের গ্রাফটা এঁকেছেন একদম সরলরৈখিকভাবে। কোনো অবনমন নেই। বরং সময়ের ব্যবধানে আরো পরিণত হয়েছেন।
ব্যাট হাতে রান, কিংবা বল হাতে উইকেট- দুটোকেই পুরনো অভ্যাসেই আটকে রেখেছেন। আর সেই অভ্যাসে অনেক কিছু পাল্টে গেলেও পাল্টায়নি সাকিবের রাজত্ব। ১৪ বছর আগে, সাকিব ছিলেন ওয়ানডের সেরা অলরাউন্ডার। ১৪ বছর পরে এসেও, সেরা অলরাউন্ডারের সেই নামটা এখনো অপরিবর্তিত- সাকিব।
অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ে সাকিবের ধ্রুব হয়ে ওঠা রাজত্বে আরেকটি ব্যাপার পাল্টেছে অবশ্য। ১৪ বছর আগে, সাকিব লড়তেন যুবরাজ সিং, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফদের সাথে। এখন লড়ছেন মোহাম্মদ নবী, রশিদ খানদের সাথে। ব্যবধানটা এক যুগ পেড়িয়ে ১৪ বছরের। দীর্ঘ এ সময়ে সাকিবের সাথে টেক্কা দিয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ সফলও হয়েছেন। সাকিবকে হটিয়ে বসেছেন ঐ সিংহাসনে। কিন্তু সাকিব সেই জায়গাটা পুনরুদ্ধার করেছেন বারবার।
টানা ১৪ বছর এমন ধারাবাহিকতা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। সেরা অলরাউন্ডারের র্যাংকিংয়ে অনেকেই শীর্ষ স্থান দখল করেছেন। কিন্তু সাকিবের অনন্যতাটা হলো, সাকিব তিন ফর্ম্যাটেই একই সাথে নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার ছিলেন। যে কীর্তি সাকিব ছাড়া ক্রিকেট ইতিহাসে আর কেউ করে দেখাতে পারেননি।
বলা হয়ে থাকে, বিশ্বকাপ নাকি কিংবদন্তি তৈরির সেতুপথ। এমন বিবেচনায় তো তাহলে সাকিব কিংবদন্তিদের সর্বোচ্চ তুল্য পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন অনেক আগেই। বিশ্বকাপের ইতিহাসে নবম সর্বোচ্চ রান সাকিবের। আর উইকেট শিকারের দৌড়ে ১৬ তম। কিন্তু যেখানে সাকিব অনন্য- ব্যাট হাতে ১০০০+ রান আর ৩০+ উইকেট পাওয়া একমাত্র ক্রিকেটারের নাম সাকিব আল হাসান।
আবার বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক আসরে যে চারজন ব্যাটার ৬০০ এর বেশি রান করেছেন তাঁর মধ্যে একজন হলেন সাকিব। শচীন টেন্ডুলকার, রোহিত শর্মা, ডেভিড ওয়ার্নারের সাথে এমন ছোট্ট তালিকায় সাকিব রয়েছেন বহাল তবিয়তে। কিন্তু বাকি তিনজনের চেয়ে সাকিব আলাদা অন্য জায়গায়, সাকিব ২০১৯ এর যে বিশ্বকাপে ৬০৬ রান করলেন, সেই বিশ্বকাপেই বল হাতে ১১ টি উইকেট নিয়েছিলেন।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক আসরে ৬০০+ রান, ১০+ উইকেট- এমন মাইলফলকে একমাত্র সাকিবই নাম লিখিয়েছেন। খুব সম্ভবত, রেকর্ড বোধহয় সাকিবের জন্যই লেখা হয়। সাকিবের জন্যই সৃষ্টি হয় ক্রিকেটের অনাগত সব রেকর্ডগুলো। যেগুলো সাকিবের স্পর্শে ভূমিষ্ঠ হয় ক্রিকেটভূমে।
এখানেই থেমে যাওয়া নয়, ৩৫ বসন্ত পার করা সাকিব ৩৬-এ এসেও ব্যাটারদের উপর ছড়ি ঘোরান। বোলারদের উপরে তাণ্ডব চালান। এই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ দিয়েই ওয়ানডেতে ৭০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করলেন। কিন্তু রেকর্ডটা যেখানে হলো- জয়াসুরিয়া, শহীদ আফ্রিদির পর ৭০০০ রান আর ৩০০ উইকেটের অনন্য এক কীর্তি গড়লেন সাকিব।
আইরিশদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের পর টি-টোয়েন্টি সিরিজেই আবার নতুন রেকর্ড গড়লেন সাকিব। ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় বারের মতো ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট সংস্করণে ৫ উইকেট নিলেন। অধিনায়ক হিসেবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ইতিহাসে ২ বার ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি শুধু ঐ সাকিবেরই।
তবে এই পাঁচ উইকেট নেওয়ার মধ্য দিয়েই আবার সাকিব গোটা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারীর তালিকায় টিম সাউদিকে টপকে উঠে গেলেন শীর্ষে।
সাকিবের এমন রেকর্ড কথন শেষ হওয়ার নয়। দিনশেষে, রেকর্ড ভাঙা গড়ার সাথেই যেন বাংলার ক্রিকেটের এ নবাবের সখ্যতা। এমন সখ্যময় সম্পর্কের ধারায় বাইশ গজ জুড়ে সাকিবের পথচলা হোক আরো সমৃদ্ধ। এক গাদা রেকর্ডে ক্রিকেট ইতিহাস বন্দী হোক সাকিবের রেকর্ডময় ক্যারিয়ার।