বাগেরহাটের সেই বাঘটা

এ পাশে ভৈরব ও পাশে রূপসা নদী।

মাঝে এক সময় ঝিক ঝিক করে চলতো ট্রেন। ট্রেন হলে কী হবে! তাতে না ছিল বুলেটের গতি, না ছিল ‘এক্সপ্রেস’-এর ত্রাস। সেই ট্রেন চলতো দুলকি চালে, ধীর গতিতে। এমন ট্রেনের শহর বাগেরহাটে জন্মে কী আর পাঞ্জাব, মেলবোর্ন, লাহোর বা নড়াইল এক্সপ্রেস হওয়া যায়!

তাহলে বাগেরহাটের ছেলেটি কী ফাস্ট বোলার হতে পারবে না?

অবশ্যই পারবে। এক্সপ্রেস ট্রেন না থাকলে কী হবে, বাঘ তো আছে! এই জেলাতেই বাস করে পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম, সুন্দরতম বাঘ-দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ছেলেটি তাই বাঘই হয়ে উঠল। অন্তত ওয়ানডে ক্রিকেটে ছেলেটি অনেকবারই প্রমাণ করেছে সে বাঘ। আসলেই ছেলেটি একটি বাঘ— বাগেরহাটের বাঘ রুবেল হোসেন!

চিরকাল পেস বোলারের হাহাকার নিয়ে পথচলা বাংলাদেশের জন্য রুবেল হোসেন শুরু থেকেই একটা বড় সম্পদ ছিলেন। কিন্তু গত বছর দুই ধরে সময়টা তার ভালো যাচ্ছে না। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়ানডেতে এক ম্যাচে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন সেই ২০১৮ সালে। এরপর থেকে কোনো ম্যাচে আর ২ উইকেটের বেশী নেওয়া হয়নি। বিশ্বকাপেও নিয়মিত ছিলেন না। গত বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরের মাঠের সিরিজে তো দলেই ছিলেন না। সবমিলিয়ে ওয়ানডে যার ফেবারিট ফরম্যাট, সেই ওয়ানডেতেই সময়টা ভালো যাচ্ছে না।

তবে রুবেল হোসেন নিশ্চয়ই হাল ছাড়ার লোক নন। নিশ্চয়ই এখান থেকে লড়াই করে ফিরে আসবেন।

লড়াই ব্যাপারটা রুবেল হোসেনের শরীরে অবশ্য অনেক আগে থেকেই অভ্যেসের মতো করে জড়িয়ে আছে।

বাগেরহাটের দড়াটানা ডাক নামের ভৈরব নদীর বাঁকের মুখেই একেবারে সাধারণ এক পরিবারে জন্ম রুবেলের। আজকের রুবেল যখন পিচ্চি ছেলে, তখনই সারা জেলার লোকেরা তাকে চিনতো এই জোরে বল করতে পারা এবং বড় বড় ছক্কা মারতে পারার কারণে। বাগেরহাট তো বটেই, খুলনা-যশোর পার করে নড়াইলেও চলে গিয়েছিল তার নাম। সেখানেই এক টেনিস বলের টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে তখনই জাতীয় তারকা হয়ে যাওয়া মাশরাফিকে বিনা রানে আউট করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন।

কিন্তু মাশরাফিকে আউট করে তো আর জাতীয় দলে আসা যায় না। সেটা এলেন গ্রামীণ ফোনের পেসার হান্ট কর্মসূচির ভেতর দিয়ে।

রুবেল তখন ঢাকায় বাছাই লিগ পার করে তৃতীয় বিভাগে খেলেন। ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হবে বলেই মনে হচ্ছিল তার। নিজেই একবার আলাপচারিতায় বলছিলেন, ‘আর ক্রিকেট চালিয়ে যেতে পারতাম না। ওই লেভেলে খেলে বাংলাদেশে কোনো পেসারের পক্ষে দৃষ্টি কাড়া প্রায় অসম্ভব। আসলেই পেসার হান্টটা না হলে আমার কোনো খোঁজ থাকতো না।’

এই আশীর্বাদ হয়ে আসা পেসার হান্টে ঘটনাচক্রে নিজের জেলা থেকে নয়, সাতক্ষীরা থেকে পরীক্ষা দিয়ে দেশের সেরা পেসার হয়ে চলে এলেন ঢাকায়।

সেটাও এক নাটকীয় ঘটনা। বাগেরহাটের পেসার হান্ট মিস করে রুবেল তখন শোকে মুহ্যমান। পারিবারিক কারণে মিস করেছিলেন বাগেরহাটের ক্যাম্প। এরপর এক বন্ধুর মারফত খবর পেলে, সাতক্ষীরায় ক্যাম্প বাকী আছে তখনও। ছুটলেন সেখানে। আর সেই ক্যাম্পে বল করে হয়ে গেলেন সেরা পেসার।

আর সেখানেই চোখে পড়লেন পেসার হান্টে কাজ করা, সাবেক জাতীয় দল কোচ সারওয়ার ইমরানের। ‘ইমার স্যার’-এর কথা বলতে বলতে রীতিমতো ছল ছল করে ওঠে রুবেলের চোখ, ‘আজ আমি যা, মনে হয় প্রায় পুরোটাই স্যারের অবদান। সেই প্রথম যেদিন স্যার সাতক্ষীরায় দেখেছিলেন, সেই থেকে সবসময় আমাকে দেখে রেখেছেন। আমি ক্যাম্পে ডাক পাওয়ার আগে স্যার ফোন করে আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসতেন জাতীয় দলের নেটে বল করার জন্য; যাতায়াত খরচটাও স্যার দিয়ে দিতেন!’

সেই নেটে বল করতে গিয়েই আসলে প্রথম ‘তারকা’ হয়ে গেলেন রুবেল। জাতীয় দল তখন যাবে শ্রীলঙ্কা সফরে। তখন রুবেল বল করতেন অনেকটাই লাসিথ মালিঙ্গার মতো সিলিং অ্যাকশনে। ফলে পত্রিকায় লেখা হল—বাংলাদেশের নেটে মালিঙ্গা!

তারপর অনূর্ধ্ব-১৯ দল, জাতীয় দল; আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রুবেলকে। এর মধ্যে ২০১৫ বিশ্বকাপে একেবারে বাংলাদেশের নায়ক হয়ে গেলেন। পুরো টুর্নামেন্টই দারুন বল করেছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের জন্য যেনো নিজেকে জমিয়ে রেখেছিলেন। সেই ম্যাচে আগেই তুলে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। শেষ দুই ওভারে ২ উইকেট হাতে নিয়ে ইংল্যান্ডের দরকার ছিলো ১৬ রান। রুবেল বল করতে এসে রানের হিসাব তো ঘোচালেনই; ইংল্যান্ডের ২ উইকেট তুলে নিলেন।

বাংলাদেশ চলে গেলো কোয়ার্টার ফাইনালে।

এরকম দিন এই প্রথম বা শেষ নয়, আগে-পরেও এসেছে রুবেলের ক্যারিয়ারে। বাংলাদেশকে জিতিয়ে বারবারই হেসেছেন আনন্দে। ওয়ানডেতে যেমন তেমন হলেও টেস্টের পারফরম্যারম্যান একেবারেই সাদামাটা।

এই ক্যারিয়ারে রুবেলের একটা সমস্যা হলো ইনজুরি। বারবারই তাকে ধারাবাহিক হতে বাধা দিয়েছে ইনজুরি। আবার মাঝে মাঝেই ফর্মহীনতা ভুগিয়েছে। এই যেমন এখন ভোগাচ্ছে। নিশ্চয়ই রুবেল বসে নেই। আবার হয়তো সেই ইমরান স্যারের কাছে ফিরে গেছেন।

লক ডাউনের সময়টাতে বাড়িতে ছিলেন। নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্য নদীর পাড়ে বালুর মধ্যে দৌড়েছেন। ফিটনেস বাড়ানোর জন্য প্রবল পরিশ্রম করেছেন। সাম্প্রতিক সময়টা যদিও ভাল যাচ্ছে না রুবেলের। কে জানে, তিনি ফিরবেন কি ফিরবেন না!

রুবেল বলছিলেন, ‘নিজের ছন্দটা ফিরে পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করছি। ফিটনেস নিয়ে অনেক কাজ করেছি। কিছু কিছু ফল পাওয়াতে ভালো লাগছে। এখন এটা ধরে রাখতে হবে।’

সেটা করে গেলেই তো লোকে মেনে নেবে যে, রুবেল আসলেই বাগেরহাটের বাঘ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link